বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম :
লিখতে চেয়েছিলাম অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে অভিনন্দন জানাতে। কিন্তু একই দিনে দুজন বর্ষীয়ান নেতার মৃত্যুতে ভীষণ ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। দুজন মন্ত্রী। একদিনে দুজন মন্ত্রী মনে হয় এর আগে প্রাণ ত্যাগ করেননি। একজন প্রাক্তন, আরেকজন বর্তমান। একজন গোপালগঞ্জের শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, অন্যজন সিরাজগঞ্জ কাজীপুরের মোহাম্মদ নাসিম। মোহাম্মদ নাসিম অনেক বড় মাপের নেতা ছিলেন, আমার খুবই প্রিয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ভারতে কষ্টকর জীবনযাপন করেছেন। যখন যেখানে দেখা হয়েছে অসম্ভব সমাদর করেছেন। আমার বাড়ি এসেছেন, তার বাড়ি গেছি। কখনো হৃদ্যতার অভাব হয়নি। মোহাম্মদ নাসিম বেশ কয়েক দিন অচেতন ছিলেন। তার চলে যাওয়া সম্পর্কে একটা প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর চলে যাওয়া নিয়ে ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। এ দুজন পরম সুহৃদকে নিয়ে পরের সংখ্যায় লিখব। এ সংখ্যায় অর্থমন্ত্রীর বাজেট ও অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা করি।
এক চরম দুঃসময়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট পেশ করেছেন। এটি তার দ্বিতীয় বাজেট। এ সময় অন্য কে কেমন বাজেট পেশ করতে পারতেন জানি না, কিন্তু বর্তমান অর্থমন্ত্রী যে বাজেট পেশ করেছেন এবং বাজেট সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘আগে ব্যয় করব, তারপর আয়ের হিসাব হবে। আগে মানুষ বাঁচাব, তারপর অন্য কথা।’ এমন দৃঢ় বক্তব্য এর আগে শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠেই শুনতাম। এই প্রথম মনে হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থ একজন সঙ্গী পেয়েছেন। অনেকে অনেক আলোচনা-সমালোচনা করতে পারে। আসলে এটা আলোচনা-সমালোচনার সময় নয়, এটা কাজের সময়। সেই কাজ সবাই করতে পারে না। কথার ফানুস অনেকেই উড়াতে পারে, কিন্তু দুর্যোগে হাল ধরতে পারে না। সে ক্ষেত্রে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সাহসী বক্তব্যকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাই। ব্যক্তিগতভাবে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। তবে জানাশোনা আছে। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালনের শুভ সূচনা অনুষ্ঠানে পুরনো বিমানবন্দরের গেটে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। তারও আগে একবার ক্রিকেটের জন্য ইসলামী ব্যাংক থেকে চাঁদা নেওয়ায় তখনকার জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল বারকাত জামায়াতে ইসলামীদের ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়া নিয়ে আ হ ম মুস্তফা কামালের নামে মারাত্মক অরুচিকর সমালোচনা করেছিলেন। আমি তার প্রতিবাদে অনেক কিছু লিখেছিলাম। পত্রিকা পড়ে ফোন করে ভর্তা ভাত খাওয়ার দাওয়াত করেছিলেন। আমি সাধারণত ভর্তা ভাতই বেশি পছন্দ করি। টাকি মাছ ভর্তা, আলু-শিম-বেগুন ভর্তা এসব আমার প্রিয় খাদ্য। কিন্তু তার দাওয়াতে আর যাওয়া হয়নি। এবার বাজেটের কতটা কী আছে তা বড় কথা নয়। বড় কথা তার দুঃসাহসিক উক্তি আমাকে ভীষণ উৎসাহিত ও মুগ্ধ করেছে। নানাজন নানা কথা বলছেন, নানা সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু এই সময় নেত্রী শেখ হাসিনা না হয়ে অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হলে এর থেকে ভালো কী করতেন আমার বুদ্ধিতে ধরে না। বরং শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কেউ সরকারে থাকলে অনেক কিছু লেজে গোবরে জড়িয়ে যেত। যত কঠিন কঠোরই হোক এ সময় শেখ হাসিনার চেয়ে দক্ষ-যোগ্য কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। যদিও করোনা আক্রান্ত মানুষের সাহায্য, সহযোগিতা ও ত্রাণকাজে নানা অনিয়ম অসঙ্গতি আছে। সব কাজে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সামনের কাতারে অথচ দোষের বেলায় শাস্তির বেলায় রাজনৈতিক লোকেরা। জাতীয় মহাদুর্যোগে কোনো সময় সরকারি কর্মচারীরা ব্যাপক ভূমিকা রাখে না, রাখতে পারে না। সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মী, জনপ্রতিনিধিরাই এ যাবৎ সব দুর্যোগ মোকাবিলা করেছে। সেই জনপ্রতিনিধি সাধারণ মানুষ সবাইকে কেমন যেন সাক্ষী গোপাল ঠুঁটু জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে। এ ধরনের প্রবণতা মোটেই ভালো নয়। এই অশুভ প্রবণতা ঠিক সময়ে প্রতিরোধ করা না গেলে পরিণাম খারাপ হতে বাধ্য। তাই সাধু সাবধান।
সম্প্রতি করোনাভাইরাস আমাদের জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে এর মধ্যেই কয়েকবার কথা হয়েছে। লোকটি শুধু ভালো ডাক্তার নন, একজন ভালো মানুষও বটে। তাই বলেছিলাম, অধ্যাপক প্রাণ গোপাল এবং এ বি এম আবদুল্লাহকে নিয়ে করোনা প্রতিরোধ জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি করলে অর্ধেক সমস্যা আপনা আপনি দূর হয়ে যাবে। কারণ তাদের নেতৃত্বে করোনা নিয়ে যে পদক্ষেপ নেওয়া হবে তাতে প্রচুর আন্তরিকতা এবং যত্ন থাকবে। করোনার যেহেতু এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা নেই, তাই আরও কিছু সময় করোনার সঙ্গে আমাদের বসবাস করতে হবে। আমাদের তো সর্দি-কাশি-জ্বর-হাঁপানি লেগেই আছে। এমনি যতটা যতœ নেই তার চেয়ে একটু বেশি যত্ন নিলেই হলো। উপমহাদেশের বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী নেত্রকোনার জর্জ বিশ্বাস আমাকে অনেকবার বলেছেন, ‘বাঘা দা, আমার জন্য হাঁপানি বোধহয় বেঁচে থাকা এবং রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার শ্রেষ্ঠ উপাদান। একটু এদিক ওদিক হলেই প্রাণ যায় যায়, দম ফেলতে পারি না। সব সময় যত্নে থাকতে হয়। সে জন্য যেমন আয়ু বেড়েছে, তেমনি রবীন্দ্রসংগীতেও নিষ্ঠা বেড়েছে।’ জর্জদার সঙ্গে ওঠাবসা করে তার কথা আমার মনে ধরেছিল। আমি ছেলেবেলায় হুপিং কাশিতে আক্রান্ত হয়েছিলাম। প্রায় তিন-চার বছর মাঝেমধ্যে শ্বাস নিতে পারতাম না, দম বন্ধ হয়ে আসত। সেই থেকে হাতে পায়ে তেল, সময়মতো মধু খাওয়া এসবই ছিল আমার নিয়মিত ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধের পরপর আমাশয় ছিল নিত্যসঙ্গী। কত রকম ওষুধ খেয়েছি, গ্লাসে গ্লাসে মধু খেয়েছি। কিন্তু আমাশয় ভালো হয়নি। ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হলে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে যখন মেঘালয়ের তুরাতে ছিলাম মাঝে মাঝেই পেটের কষ্টে অস্থির হয়ে যেতাম। ভারত সরকার আমার ভীষণ খেয়াল রাখত। চার-পাঁচ বার হেলিকপ্টারে গোহাটি-শিলং নিয়ে চিকিৎসা করেছে। শিলং অথবা গোহাটি মেডিকেল কলেজে দুই-তিন দিন থাকলেই সুস্থ। পেটে ডাকাডাকি, কামড়াকামড়ি নেই। আবার চান্দভুইয়ে ফিরলে তিন-চার দিনে যা ছিল তাই। মনে হয় পাঁচবারের বার অধ্যাপক কি এক দাশগুপ্ত, বাড়ি বিক্রমপুরে। প্রায় ৩০ বছর আসামে। তিনি এক সহযোগী অধ্যাপক পাঠালেন আমার সঙ্গে। কেন এমন হয় হাসপাতালে গেলে ভালো, তুরায় এলেই খারাপ। আমরা ক্যাম্পে ফিরে এলাম। চান্দভুইয়ে প্রায় হাজার বারো’শ প্রতিরোধ যোদ্ধা। সেখানে সুলতান, নাসিম, নড়াইলের জিন্নাহ, মানিকগঞ্জের শরীফ, মাহবুব, দুলাল, হালিম, লুৎফর, রাজা দীপঙ্কর, মহারাজা সাইদুরসহ আরও অনেকেই ছিল। গোহাটি থেকে আসা এসোসিয়েটস প্রফেসর আমার সঙ্গে খেতেন। চান্দভুই যে টিলায় হেডকোয়ার্টার, তার পাশের টিলায় আমি থাকতাম। অন্যেরা মাছ-মাংস এটা ওটা খেলেও আমি কোনো মাংস খেতাম না। ছোট ছোট মাছ, সবজি ছিল আমার খাবার। কিন্তু বড় পরিষ্কার পরিপাটি। ’৭৩-৭৪ এ একদিন টাঙ্গাইল থানাপাড়ায় সুইপাররা দাওয়াত করেছিল। আমার জীবনে অত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন খাবার পরিবেশন দেখিনি। মেথরপট্টিতে হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও একবার খেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ প্রতিরোধ শুরুর দিকে দুই-তিন বার একদিন, দুদিন এমনকি তিন দিন পর্যন্ত স্বাভাবিক খাবার পাইনি। কিন্তু আমরা যখন মোটামুটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম তখন খাবার যাই জোটত বড় সুন্দর পাকসাফ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে পরিবেশন করা হতো। খাবার-দাবার তেমন ছিল না। যা ছিল তাই যত্ন করে পরিবেশন করত। সহকর্মীরা কলাগাছের খোল কেটে ভাত খেত। আমার জন্য চালের টিন পিটিয়ে একটা থালা বানানো হয়েছিল। সেটা চকচকে মাঝাঘষা করে আনা হতো অথচ ১৫-২০ মিনিট থাকলেই কালো হয়ে যেত। যা হোক এক দুপুরে ৩-৪ জন খাবার খাচ্ছিলাম। সেই সহযোগী অধ্যাপকও ছিল। তখন তার ৪-৫ দিন হয়ে গেছে। খেতে খেতে হঠাৎ বলল, ‘স্যার, আপনার লোকজনের তো অভাব নেই। এতো পরিষ্কার পরিপাটি খাবার এতে তো পেটে কোনো কষ্ট হওয়ার কথা না। আচ্ছা স্যার, আপনি পানি ফুটিয়ে খেতে পারেন না?’
– কেন পারব না?
পরের দিনই ফুটানো পানি পান করা শুরু হলো। সে ছিল ’৭৬-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চের কথা। আজ ২০২০ সালের জুন মাস। সেই যে ফুটানো পানি খাওয়া শুরু হয়েছে এখনো একদিন এক চামচ কাঁচা পানি পেটে গেলে অবস্থা বেসামাল হয়ে যায়। ফুটানো পানি পান করি, বাজারের কয়েকটি পানির মধ্যে দু-একটা সুড করে সেগুলো পান করি। এতে কোনো অসুবিধা হয় না। তাই করোনার যেহেতু চিকিৎসা নেই, সেহেতু নিজেদেরই যত্ন নিতে হবে, চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। আজ তিন মাস নিয়মিত এক চামচ মধুর সঙ্গে ২০-৫০টা কালিজিরা, একটু জিরার গুঁড়া, জৈন মিলিয়ে প্রতিদিন খাই। কোনো কষ্ট হয় না। আমি সর্দি-কাশির চির রোগী। মাসে দু-একবার সর্দির দোষ হবেই। কিন্তু এখন তাও হয় না। কালিজিরা-আদা-লেবু-নিষিন্ধা-জৈন এসব একটু খেলে আর প্রয়োজন মতো গরম পানি ব্যবহার করলে সবাই করোনা থেকে ভালো থাকতে পারবে। সব সময় সবক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সুযোগ পেলে বেসরকারি লোকজনকে ডুবাতে চেষ্টা করে। এক্ষেত্রেও তেমনটা যে হচ্ছে না তা বলা যায় না। সরকার এবং দল অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের ওপর আওয়ামী নেতাদের এখন তেমন একটা প্রভাব নেই। আস্থা বিশ্বাসের অভাব আগাগোড়াই ছিল কিন্তু সেটা এখন আরও চরম আকার ধারণ করেছে। দুর্নীতি সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারাও করছে কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বা রাজনৈতিক মানুষের ওপর খড়গ চলছে বেসুমার।
তবে পুলিশের ভূমিকায় দেশের আপামর জনসাধারণ অনেকটাই সন্তুষ্ট। আনসার-ভিডিপি-র্যাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব সদস্য তাদের সাধ্যমতো কাজ করে চলেছে। এই সেবার মনোভাব অব্যাহত রাখতে পারলে আমার বিশ্বাস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ব্যক্তিবর্গ মানুষের আস্থা ও ভালোবাসায় টইটুম্বর হয়ে থাকবে।
লেখক : রাজনীতিক।
www.ksjleague.com