রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৬:০৮ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
কারারুদ্ধ গণতন্ত্র : ১ কোটি গণমানুষের গণস্বাক্ষর

ড. কে এ এম শাহাদত হোসেন মন্ডল  : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের প্রেক্ষিতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যাক্ত পুরানো কারাগারের এক নির্জন কক্ষে অন্তরীণ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় আপোসহীন নেত্রী, গণতন্ত্রের জননী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। এ ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিশ্বাস, বেগম খালেদা জিয়াকে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই এ রায় দেয়া হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর ভাষায়, ‘সরকারের প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশস্বরূপ বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার জেল হবে, তাঁকে কারাগারে যেতে হবেই, এমন কথা সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও সরকার দলীয় নেতারা বিগত দু’ বছর ধরেই বলে আসছেন। ৮ ফেব্রæয়ারির রায় ঘোষণার পরও দেখা গেছে, সরকারের মন্ত্রীদের দেয়া বক্তব্যের সঙ্গে আদালতের রায়ের হুবহু মিল রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন ও তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা সাজানো মামলায় সাজা দেয়ার ঘটনায় সারাদেশে নিন্দার ঝড় বইছে। অহিংস আন্দোলনের কর্মসূচী হিসেবে চলছে সারাদেশব্যাপী অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন, প্রতিকী অনশন, লিফলেট বিতরণ ও কালো পতাকা প্রদর্শন। ইতিমধ্যে বেগম জিয়ার মুক্তির দাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রায় এক কোটি মানুষ গণস্বাক্ষর কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন। এই রায়কে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ দেশের সাধারণ মানুষ।
বেগম জিয়া তাঁর ৩৬ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখী হয়েছেন। তার অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে। জীবন বাজিরেখে তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে কখনও সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে কখনও ১/১১-এর অগণতান্ত্রিক অবৈধ ‘উদ্দীনগং’ সরকারের বিরুদ্ধে; এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য। তাকে লড়াই করতে হচ্ছে। বেগম জিয়ার মাথার উপর আরও ৩৪টি মামলা ঝুলছে। এরপরেও তিনি আন্দোলনের পথ থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সরে আসেননি। তিনি ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, ‘যতদিন বেঁচে থাকবেন তিনি গণতন্ত্রের জন্য এই আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন আপোসহীনভাবে।’
বেগম জিয়ার জনপ্রিয়তা আজ আকাশচুম্বী। একদিকে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ (মামলা) দেশের মানুষ সত্য বলে মোটেও বিশ্বাস করে না, পাশাপাশি তাঁর প্রতি জনগণের সহানুভ‚তি দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে জনগণের মনে যে বিষয়টি দৃঢ় হয়েছে তা হলো, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১/১১-এর সরকারের দায়েরকৃত প্রায় সাড়ে সাত হাজার মামলা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলে প্রত্যাহার করে নেয়া হলেও বেগম জিয়া ও বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১/১১-এর সরকারের দায়েরকৃত অনুরূপ একটি মামলাও প্রত্যাহার করা হয়নি- বরং নতুন করে বহু মামলা দায়ের করা হয়েছে যা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উদ্দেশ্য, বেগম জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। এটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, কারান্তরীণ বেগম জিয়ার জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটারের পারদ আজ ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী। তিনি শুধু আজ কেবলমাত্র দলীয় নেত্রী বা দেশনেত্রী নন, তিনি আজ দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মা’য়ে রূপান্তরিত হয়েছেন। আপোসহীন লড়াইয়ের মাধ্যমেই তিনি আজ বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্রের জননী’ বা ‘মাদার অব ডেমোক্রেসী’। বিশিষ্ট সাংবাদিক মোবায়েদুর রহমানের ভাষায়, ‘বেগম খালেদা জিয়া আজ ম্যাডাম থেকে মমতাময়ী মায়ের আসনে আসীন। এটি ৪৭ বছরের ইতিহাসে বিরল। কারাদন্ড দেয়ার ফলে প্রতিটি দিন যাচ্ছে আর বেগম জিয়ার জনপ্রিয়তা হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন বেগম জিয়ার জনপ্রিয়তা হবে হিমালয়ের মত উঁচু এবং তিনি হবেন মহান নেতা। ইতোমধ্যে তিনি সম্মান, সহানুভ‚তি এবং জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে অনন্য উচ্চতায় উঠে গেছেন। এখন তাঁর লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী তাঁকে আর ম্যাডাম ডাকে না। জেলে যাওয়ার পর থেকেই তিনি রূপান্তরিত হয়েছেন এক মমতাময়ী মাতৃরূপে। দেশনেত্রী বা ম্যাডাম থেকে মায়ের মর্যাদায় আসীন হওয়া বাংলাদেশের ৪৭ বছরের ইতিহাসে আমরা ইতিপূর্বে দেখিনি।’
এটি সত্য যে, বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচার এরশাদের হাত থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন। এছাড়া বিগত ৩৬ বছর ধরে তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও প্রতিষ্ঠার জন্য আপোসহীনভাবে লড়াই করে চলেছেন। তাই তিনি আজ গণতন্ত্রের প্রতীক। বেগম জিয়া মানেই আপোসহীন লড়াই, বেগম জিয়া মানেই গণতন্ত্র। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. মো. শরিফ উদ্দিনের ভাষায় ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াই অগ্রসেনানী, অথচ সেই গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের পুরস্কার হিসেবে জনগণের ভোটবিহীন আওয়ামী লীগ সরকার এক পরিত্যাক্ত কারাগারের নির্জন কক্ষে বন্দি রেখেছে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। অন্যদিকে আদালত সরকার নিয়ন্ত্রিত জেনেও খালেদা জিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে কারাগারের নির্জন কক্ষে দিনযাপন করছেন, যেন বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ বন্দি হয়ে পড়েছে নাজিমউদ্দিন রোডের এক নির্জন প্রকোষ্ঠে। চারদিকে আজ আওয়াজ উঠেছে, খালেদা জিয়া আজ কারাগারে নয়, কারাগারে বন্দি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের গণতন্ত্র।’
এটি আজ দিবালোকের মত সত্য ও সুস্পষ্ট যে, বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক মামলায় যেনতেনভাবে সাজা দিয়ে কারাবন্দি রাখাটা সরকারের রাজনৈতিক সুদূরপ্রসারী হীন চক্রান্তের অংশ। সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বেগম জিয়াকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে চি‎িহ্নত করে জেলে আটক রাখা এবং আদালতের মাধ্যমে অযোগ্য ঘোষণার দিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। কিন্তু সরকার ও সরকারি দল অপপ্রচার করুক না কেন, জনগণের মনে আজ এ ধারণা ও বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছে যে, এই মামলাটা সাজানো, বানানো, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন রাজনৈতিক মামলা এবং এ রায় সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন।
পরিশেষে গণতন্ত্রর স্বার্থে সরকার ও সরকারি দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিশিষ্ট কলামিষ্ট মোহাম্মদ আবদুল গফুর-এর ভাষায় বলতে চাই ‘গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে নিজের বিশ্বাসের পাশাপাশি বিপরীত পক্ষের বিশ্বাসের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল থাকা। এই মূল বৈশিষ্ট্যেই যার বিশ্বাস নেই তিনি কখনও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হতে পারেন না। মানুষ সাধারণত তার নিজের ভুল নিজে বুঝতে পারে না। তার নিজের ভুল সংশোধনের জন্য এ কারণেই শক্তিশালী বিরোধী দল অপরিহার্য। নইলে তাঁর দ্বারা ভুল সংঘাটিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে যিনি রাষ্ট্রের যত বড় দায়িত্বে থাকবেন, তাঁর দ্বারা রাষ্ট্রের তত বড় ক্ষতি হওয়ায় আশঙ্কা। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।’সূত্র : ইনকিলাব
লেখক: প্রফেসর, ইন্সটিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।