সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০১:০৭ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত

শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষা বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান, উপ মহাদেশের ১ম মুসলিম প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর ৪০ তম মৃত্যু বার্ষিকী বৃহস্পতিবার (২৯ মার্চ) পালিত হয়েছে। তিনি ১৮৯৪ সালে টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুর থানার শাবাজনগরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম শাবাজ খাঁ ও মায়ের নাম রতন খানম। ১৯৭৮ সালের ২৯ মার্চ বুধবার মৃত্যুবরণ করেন।

তাঁর এই বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলকে সমৃদ্ধি করার লক্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাইলট হাই স্কুল, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, ইব্রাহীম খাঁ কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ইব্রাহীম খাঁ কলেজের পক্ষ থেকে চিত্রাংকন, কুইজ প্রতিযোগিতা ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এছাড়াও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের নেতৃত্বে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, শিক্ষক, শিক্ষিকা ও ছাত্র/ছাত্রীদের নিয়ে র‌্যালী করে ইব্রাহীম খাঁ পাঠাগার সংলগ্ন কবরে পুস্পস্তবক অর্পন করেন। পরে স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানে দোয়া ও আলোচনাসভা করা হয় স্থানীয় মসজিদ গুলোতে নামাজবাদ তাঁহার রূহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া করা হয়।

মানুষ হিসেবে ছিলেন তিনি চমৎকার এক লোক। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন খোশ মেজাজি, সদালাপি, বিনয়ী। তার মেহমানদারি কিংবদন্তির মতো। কর্মযোগী, শিক্ষাব্রতী, সাহিত্যিক এবং সমাজ সংস্কারক প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ আমাদের গৌরব, আমাদের অহঙ্কার।

তারই রচনা থেকে জানা যায় : “আপনারা হয়তো অবগত আছেন যে, আমার কর্মজীবনের এক বিপুল অংশ আমি সাহিত্য সেবায় যাপন করেছি। সাহিত্য রচনা আমার বিলাস ছিল না, এ ছিল আমার জীবনের অন্যতম তপস্যা। এই তপস্যার মারফত আমি আমার তন্দ্রাহত সমাজকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। আমার সে আহ্বানে সব নিন্দ্রাহত নিদ্রাভঙ্গ হয় নাই সত্য, তবে অনেকে মোচড় দিয়ে অর্ধজাগ্রত হয়েছে, আর কতকে পূর্ণ জাগৃতি নিয়ে উঠে বসেছে। আমার এই ক্ষুদ্র সাফল্যকে আমার জীবনের অন্যতম সার্থকতা বলে আমি মনে করি। আমি অনুভব করি আমার সে আহ্বানের প্রয়োজন আজো মিটে নাই। আজও আমরা কর্মের ক্ষেত্রে ও সাহিত্যের সাধনায় বহু সভ্য জাতির হাজারো মাইল পিছনে পড়ে আছি।”

সাহিত্য এবং ভাষা সম্পর্কে তার অকপট বক্তব্য : “একটি হরফ-জ্ঞান নাই, এমন লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি মানুষ বাংলার পুথিগ্রন্থ থেকে পেয়ে আসছিল সাহিত্যের রস, চিত্তের আনন্দ, প্রাণের খোরাক। আমরা জনগণের সাহিত্য জনগণের জন্য ফিরিয়ে দিতে চাই। আমরা পুথি সাহিত্য চাই না। যে সাহিত্যকে তোমরা বড়রা নিজের হাতে হত্যা করেছ তার পুনর্জন্ম সম্ভব নয়। আমরা চাই সহজ সুন্দর ভাষায় লিখিত জনগণের উপযোগী সাহিত্য। অকারণে হরফের জুলুম এ আর আমরা বরদাশত করতে চাই না। অপ্রচলিত বড় বড় পণ্ডিতি শব্দ ওসবে আমাদের আর পোষায় না।”

ইবরাহীম খাঁর মানসিকতা, মেজাজ তার আগ্রহ বোধকরি পরিস্ফুট হয়েছে অনেকখানি। এই কর্মযোগীর সাধনা ছিল দেশের, সমাজের এবং মানুষের মঙ্গল কামনা, তার প্রিয় প্রসঙ্গ ধর্ম, শিক্ষা ও সাহিত্য। তিনি তার বিচারে নাস্তিকতাকে প্রশ্রয় দেননি, শুষ্ক সাহিত্যকেও স্থান দেননি। স্ববিজ্ঞতাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন এবং যাবতীয় জ্ঞান-বিস্তারে প্রাণের মূল্যকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন।

তিনি ফসলান্দি ও লোকেরপাড়া পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। প্রথমে হেমনগর ও পরে পিংনা হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। পিংনা হাইস্কুল থেকেই ১৯১২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে ১৯১৪ সালে আইএ এবং কলকাতার সেন্ট পলস কলেজ থেকে ১৯১৬ সালে ইংরেজিতে অনার্স পাস করেন। ১৯১৯ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ পাস করেন এবং ১৯২৩ সালে বিএল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

এ পরীক্ষার পরই তিনি করটিয়া ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চাঁদ মিয়া প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। অসহযোগ, খেলাফত আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এলে জাতীয় বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়- তিনি ময়মনসিংহ জজ কোর্টে ওকালতি শুরু করেন।

চাঁদ মিয়ার আহ্বানে ওকালতি ছেড়ে তিনি সাদত কলেজ গড়ায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি একটানা ২২ বছর এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। বাংলা, বিহার এবং আসামে মুসলিম অধ্যক্ষ পরিচালিত তখন এই একটি কলেজই ছিল। এ জন্যই প্রিন্সিপাল শব্দটি তার নামের সাথে গেঁথে যায়।

পাকিস্তান হলে তিনি পূর্ববঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার পালন করেন।

শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ রাজনীতির সাথেও জড়িয়ে পড়েন। সাবেক পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদ, গণপরিষদ ও জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন। ময়মনসিংহে অসহযোগ আন্দোলন, চাষি আন্দোলন, রায়ত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।

তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন।

তার প্রচেষ্টায় টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর স্কুল, ভূয়াপুর গার্লস স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, সাবরেজিস্ট্রার অফিস, কাজী অফিস, পোস্ট ও টেলিগ্রাম অফিস, থানা ক্লাব এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ভূয়াপুরের রাস্তাঘাটের এবং টাঙ্গাইল জেলা হওয়ার পেছনে এই ব্যক্তিত্বের অবদান রয়েছে।

ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে মহাপ্রাণ মনীষী ইবরাহীম খাঁ কর্মজীবনের শুরুতেই অসহযোগ আন্দোলন এবং খেলাফত আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এই আন্দোলন তার গভীরভাবে জনজীবনের সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের ভিত তৈরি করে দেয়। সে সময়ের আশরাফ-আতরাফ সমস্যা তাকে পীড়িত করেছিল। অনেক মসজিদে কলু, তাঁতি, নিম্ন শ্রেণীর মুসলমানকে প্রথম কাতারে নামাজ পড়তে দেয়া হতো না। একসঙ্গে খানাপিনা করার চিন্তাও সে সময়ে অনেকে করতে পারতেন না। শুধু বুদ্ধিতে আস্থাবান, কল্যাণকামী চিন্তায় আলোড়িত ইবরাহীম খাঁ এসবকে আঘাত করেছিলেন। সেই সময় মুসলিম মনে আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করার জন্য তিনি ইতিহাস, সমকালীন জীবন নিয়ে, ইসলামের গৌরবময় অধ্যায় নিয়ে লিখেছেন- এটাকেই তিনি তপস্যা বলেছেন।

তিনি ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। স্বসম্প্রদায়ের জন্য তার অসীম দরদ ছিল, প্রচণ্ড অনুরাগ ছিল- কিন্তু অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি ছিল তার অসীম ভালোবাসা।

ব্রিটিশ ভারতে নিগৃহীত পণ্ডিতদেরকে তিনি তার কলেজে সুযোগ দিতেন- এমনকি অন্যত্র বহিষ্কৃত ছাত্ররাও তার আশ্রয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। তিনি তার নিজের বিশ্বাসে দৃঢ় ছিলেন, কিন্তু অন্যের মতবাদকে বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধা করতেন না। উদার মানবতাবাদী ইবরাহীম খাঁর সাহিত্যচর্চার প্রধান উৎসই শিক্ষা এবং সংস্কার- তিনি মূলত সংস্কারকই। অসংখ্য শৈবালদামে আচ্ছন্ন স্রোতধারার সংস্কারকেও কিছুটা বিপ্লবী ভূমিকা গ্রহণ করতে হয়- তিনি তা করেছেন।

তিনি নিজে যেমন সাহিত্যচর্চা করেছেন, তার চেয়ে বেশি অন্যকে সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করেছেন। মহুয়া মজলিশ ছিল বড়দের সাহিত্য সংগঠন- ছোটদের জন্য ছিল কাকলিকুঞ্জ। ছোটদেরকে তিনি সম্মান করতেন। তিনি জানতেন, যা কিছু জাতির গৌরবের, শ্রদ্ধার এবং সম্মানের তা রক্ষা করবে তরুণরাই, এই ঐতিহ্যপ্রীতির লক্ষণ রয়েছে তার বিপুল সাহিত্য সৃষ্টিতে।

আমরা তার প্রকাশিত রচনাবলির সামান্য কিছু পরিচয় তুলে ধরছি:

নাটক : কামাল পাশা, আনোয়ার পাশা, কাফেলা, ঋণ পরিশোধ, ভিস্তি ও বাদশাহ, মায়ের বুলি, মঞ্চিকা, ৩৬টি নাট্যকথা, ১০টি নাটিকার সংকলন।

ছোটদের জন্য নাটক : জঙ্গী বেগম, নিজাম ডাকাত।

জীবন্তিকা ছোটদের : বাবর, সালাহউদ্দিন, নজরুল ইসলাম, আমাদের মহানবী, ওমর ফারুক।

ছোটদের জন্য তার অন্যান্য গ্রন্থ : কবিতায় ক-খ, শিয়াল পণ্ডিত, ব্যাঘ্র মামা, নীল হরিণ, দাদুর জাম্বিল, খবরাখবর, গুলবাগিচা,

নবজীবনের ঝাণ্ডা বহিল যারা, তুর্কী উপকথা, ছেলেদের শাহনামা, বিচিত্রা।

উপন্যাস ও ছোটগল্প : বৌ-বেগম, লক্ষ্মীছাড়া, সোনার শিকল, মনীষী মজলিস, গল্প দাদুর আসর, ওস্তাদ, আলু বোখারা, মানুষ, গল্পে ফজলুল হক, পাখির বিদায়।

ভ্রমণ কাহিনী : ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র, পশ্চিম পাকিস্তানের পথে ঘাটে, নয়াজগতের পথে, নয়াচীনে এক চক্কর।

ধর্মবিষয়ক : মহানবী মুহম্মদ, ইসলাম সোপান, ইসলামের মর্মকথা, বাংলায় ছোটদের মিলাদুন্নবী, মুসলিম জাহানে সংস্কার আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা।

নীতি কাহিনী : হীরক হার।

শিক্ষা, সমাজ ও সাহিত্য : আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, ভাষণগুচ্ছ, নজরুলিকী।

চিঠিপত্র : লিপি সংলাপ।

অনুবাদ : সূর্যি মামার রথে, আরব জাতি, নূরমহল, চেঙ্গীজ খাঁ, মহীয়ান সুলায়মান, আইনস্টাইন, ইতিহাসের আগে, বরফের দেশে, জর্জ ওয়াশিংটন, সিন্দবাদ জাহাজী, বাবরের স্মৃতিকথা, আপন চলার বাল্যকাল, খালেদার সমরস্মৃতি, তুর্কী উপকথা, ইতিকাহিনী, ছোটদের জাতিসংঘ, সবাই মিলে গড়লাম যে বাগান।

ইংরেজি রচনা : Anecdotes from Islam, Gleanings in golden fields, To my students, A peep into our Rebel Poet.

এ ছাড়াও প্রায় ত্রিশটির মতো পাণ্ডুলিপি তিনি রেখে গেছেন। তার সমগ্র রচনাবলি প্রকাশিত হলেই এই কর্মযোগী লেখকের লেখার বিপুল পরিমাণ যেমন বিস্ময়ের উদ্রেক করবে, তেমনি বিচিত্র বিষয়ে তার অসীম জ্ঞান আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করবে।

তিনি শুধু প্রথম শ্রেণীর লেখকই ছিলেন না, পাঠকও ছিলেন। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ দেখলে বোঝা যায় এই মনীষীর পাঠ্যভ্যাসের গভীরতা কতখানি। শুধু বাংলা বা ইংরেজিই নয়, আরবি, ফার্সি এবং উর্দু ভাষায় তার অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য তার গ্রন্থ অধুনা দু®প্রাপ্য। তার গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হলে আমাদের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতো। জাতির মঙ্গলের জন্যই ইবরাহীম খাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন।

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।