রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৩:২৭ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
ভাঙল অমর একুশে বইমেলা

একুশে বার্তা ডেক্স :  অবশেষে ভাঙল বাঙালীর ভাষা চেতনার উজ্জ্বল প্রকাশ অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ফেব্রুয়ারির মেলা হিসেবে আলাদা ভাব ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করা মেলা এবার গড়ায় ২ মার্চে। নির্ধারিত সময়ের দুদিন পর শনিবার আয়োজনের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। এবারের আয়োজন ছিল অন্য যে কোন বারের চেয়ে গোছাল। পরিপাটি। কিন্তু বর্ধিত সময়ের বারোয়ারি চেহারা আয়োজক বাংলা একাডেমির সাফল্য কিছুটা হলেও ম্লান করেছে।

বাংলা একাডেমি চত্বর ও ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বিশাল পরিসরে এবার মেলার আয়োজন করা হয়। প্রায় ৩ লাখ বর্গফুট জায়গা জুড়ে মেলায় অংশ নেয় ৪৯৯টি প্রতিষ্ঠান। মেলায় বই প্রদর্শনী ও সংগ্রহের পাশাপাশি চলে প্রাণখোলা গল্প আড্ডা। ৩০ দিনের মেলায় প্রায় ৪ হাজার ৮শ’ নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। বিক্রি হয়েছে আনুমানিক ৮০ কোটি টাকার বই। সংখ্যা ও বিক্রি বাড়লেও, বইয়ের মান বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে বলে মনে করেন বিদগ্ধ পাঠকরা।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা দেশে বইকেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় আয়োজন। কালক্রমে আয়োজনটি বঙ্গ সংস্কৃতির মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রতিবারের মতোই বাঙালী জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক বাংলা একাডেমি এ মেলার আয়োজন করে। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১ ফেব্রুয়ারি মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দেশের প্রায় সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এ মেলায় অংশ নেয়। প্রায় ৩ লাখ বর্গফুট জায়গার এ মেলায় শুধু একাডেমি প্রাঙ্গণে ছিল ১০৪ সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। তারুণ্যের প্ল্যাটফর্ম লিটল ম্যাগাজিন চত্বরও ছিল এ অংশে। বয়ড়াতলায় ১৮০ লিটলম্যাগকে বরাদ্দ দেয়া হয় ১৫৫ স্টল।

বইয়ের মূল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। চার চত্বরে বিন্যস্ত উদ্যানে ৩৯৫ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান স্টল ও প্যাভিলিয়ন সাজায়। বাংলা একাডেমিসহ ২৪ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয় ২৪ প্যাভিলিয়ন। সব মিলিয়ে এবার মেলায় অংশ নেয় ৪৯৯ প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলোকে বরাদ্দ দেয়া হয় ৭৭০ ইউনিট।

এবারও মেলার প্রতিদিন এসেছে নতুন নতুন বই। সংখ্যায় বেশি ছিল উপন্যাস। গল্প-কবিতাও এসেছে প্রচুর। ইতিহাস প্রবন্ধ মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়ে গবেষণামূলক বই প্রকাশিত হলেও সংখ্যায় ছিল খুবই কম। মেলার সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ জানান, ৩০ দিনে মেলায় নতুন বই আসে ৪ হাজার ৮৩৪।

মেলায় কত বই বিক্রি হয়েছে তার পরিসংখ্যান প্রকাশকরা একদমই দিতে চান না। তবে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের হিসেবে থেকে অন্যদের বিক্রি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। জালাল আহমেদ জানান, ১ মার্চ পর্যন্ত শুধু বাংলা একাডেমি বিক্রি করেছে প্রায় ২ কোটি ২৪ লাখ টাকার বই। ২ মার্চের আনুমানিক বিক্রি ধরে তিনি বলেন, ৩০ দিনে একাডেমির মোট বিক্রি হবে ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অন্যান্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বিক্রিও এবার বেড়েছে বলে মত দেন তিনি। এবার মোট বিক্রি গত বছরের তুলনায় ১০ ভাগ বেড়েছে। বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের আলোকে তিনি জানান, মেলায় সব মিলিয়ে ৮০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে।

অবশ্য প্রকাশকরা একাডেমির দেয়া বিক্রির হিসাব মানতে নারাজ। এ সম্পর্কে প্রকাশক নেতা ও অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, মেলায় ৮০ কোটি টাকা বিক্রি হওয়ার তথ্য অবাস্তব। ভোগাস। এমনকি উদ্যানের একেবারে শেষ প্রান্তে জায়গা হওয়ায় আমাদের প্রতিষ্ঠানের বিক্রি গত বারের চেয়ে ১৫ ভাগ কম হয়েছে। তিনি বলেন, গত বছর একাডেমি জানিয়েছিল, ৭০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ১০ কোটি টাকা বেড়ে গেল, এটা কী সম্ভব? প্রশ্ন রাখেন তিনি।

প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এ্যাডর্নের কর্ণধার সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, মেলায় বই বিক্রি মূল উদ্দেশ্য নয়। এখানে বইয়ের সুন্দর একটি প্রদর্শনী হয়, এবারও হয়েছে। তবে বিক্রির যে হিসাব একাডেমি দিয়েছে সেটি একেবারেই সত্যি নয়। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে এমন হিসাব দেয়া অনুচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। অবশ্য অনেক প্রতিষ্ঠানই মেলার বিক্রিতে খুশি। যুবজাগরণ নামে একটি স্টলে মাত্র কয়েকটি বই রাখা হয়েছিল। ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বিষয়ে লেখা বই হওয়ায় ভাল বিক্রি হয়েছে। স্টলটি থেকে জানানো হয়, মেলায় তারা প্রায় ১২ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছেন।

লক্ষণীয় প্রবণতা ॥ এবারও মেলায় পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বই ছিল মূল আকর্ষণ হয়ে। কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, নাসরিন জাহানের নতুন বই এসেছে। জনপ্রিয় ধারার রচনা সম্ভার নিয়ে মেলায় ছিলেন ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, সুমন্ত আসলাম, সাদাত হোসাইনসহ কয়েকজন। আর ছোটরা ঘিরে রেখেছিল তাদের সবচেয়ে প্রিয় সায়েন্স ফিকশন লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে। কিশোরদের আরেক প্রিয় লেখক মোশতাক আহমেদ। তার কল্পবিজ্ঞানও পড়ছে ছোটরা। ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লেখা মুনতাসীর মামুনের বই মেলাকে সমৃদ্ধ করেছে। এসেছে বিশিষ্টজনদের লেখা স্মৃতি কথা। আবার তাদের নিয়ে অন্যদের লেখা বইও আলোচনায় এসেছে। চিরায়ত সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছিল সব সময়ের মতোই। প্রয়াত লেখকদের বিখ্যাত রচনাগুলোও সংগ্রহ করেছেন নবীন পাঠকেরা।

তবে চোখের সামনে বেশি ঘুরঘুর করেছেন মৌসুমি লেখকরা। তাদের অস্বস্তিকর প্রচার চোখে পড়েছে প্রতিদিনই। কিন্তু সাহিত্যমান ও বিক্রির জায়গা থেকে এ অংশটির অবদান শূন্যের কোটায় বলে প্রতীয়মান হয়েছে। নাম প্রচারে ব্যস্ত লেখকেরা বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখলেও মানের দিক থেকে মারাত্মক পিছিয়ে। এ কারণে মেলায় আসা মোট বইয়ের তুলনায় মানসম্পন্ন সংখ্যা অনেক কম। বাংলা একাডেমি মানসম্পন্ন খুঁজে দেখার একটি চেষ্টা করেছে। তাতে দেখা যায়, মেলার ২৮ দিনে মানসম্পন্ন বই এসেছে মাত্র ১ হাজার ১৫১। পরের দুই দিনে এ সংখ্যা খুব একটা বাড়েনি বলে জানা যায়।

মৌসুমি লেখকদের মতো মেলায় ছিলেন মৌসুমি প্রকাশকরাও। দোকানদারিটাই শুধু করেছেন তারা। মেলার নীতিমালা ভঙ্গের অপরাধে এ ধরনের ১১ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শাও নোটিস দেয় বাংলা একাডেমি।

মৌসুমি লেখক প্রকাশকদের নিয়ে ভাল ঝক্কিতে আছে বাংলা একাডেমিও। এদের কারণে মেলার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। তেমনি কমছে বইয়ের মান। এবারও মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা অনেক কম হওয়ায় খারাপ লাগা আছে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লা সিরাজীর। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মেলায় প্রচুর বই আসছে। আমরাও চাই, আসুক। কিন্তু মান বৃদ্ধি করা খুব জরুরী। এ জন্য মৌসুমি লেখক ও প্রকাশকদের দায়ী করা হচ্ছে অনেক বছর ধরেই। এ ব্যাপারে একমত প্রকাশ করে মহাপরিচালক বলেন, খ্যাতি অর্জনের নেশায় বই লিখে কিছু পাওয়া যায় না। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মাথায় রাখতে হবে, এটা দোকানদারি নয়। আগামী মেলায় বাজারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুৎসাহিত করা হবে বলে জানান তিনি। বলেন, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানসম্পন্ন বই প্রকাশ করতে হবে। তা না হলে আগামী মেলায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে বলে জানান তিনি।

অন্য সমালোচনার মধ্যে ছিল গাড়ির উৎপাত। এবারই প্রথম মেলা প্রাঙ্গণে গাড়ি ঢুকতে দেখা যায়। একেবারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাড়ি নিয়ে ঢুকে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন একজন প্রতিমন্ত্রী। পেটমোটা গাড়ি নিয়ে প্রতিদিনই মেলায় প্রবেশ করতে দেখা যায় সরকারের বিভিন্ন দফতর অধিদফতরের বড় কর্তাদের। পুলিশ র‌্যাবসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতনরা যেমন খুশি গাড়ি হাঁকিয়েছেন। এমনকি অনেক প্রকাশক গাড়িয়ে নিয়ে মেলায় প্রবেশ করেছেন। আগে কোনদিন এমন দৃশ্য দেখা যায়নি। এর ফলে দুর্ভোগ বেড়েছে সাধারণ মানুষের। দুর্ঘটনারও শঙ্কা ছিল। অনেকে বলছেন, বাংলা একাডেমির দুর্বলতার কারণে এমনটি হয়েছে। একে আর বাড়তে না দেয়ার পক্ষে মত দিয়ে বইপ্রেমীরা বলেছেন, অল্প জায়গা হেঁটে পার হতে না পারলে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা আছে। এর পরও ক্ষমতার দাপট দেখানোর ব্যবস্থা রাখা হলে একুশের মেলার সৌন্দর্য ও ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট হবে।

বর্ধিত সময়ে বারোয়ারি মেলা ॥ বর্ধিত সময়ে এসে একেবারেই অন্য চেহারা দেখা যায়। পুলিশ সদস্যদের বড় অংশটিকে আগেই সরিয়ে নেয়ায় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। বিশৃঙ্খল একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়। টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত রাস্তাটি রিক্সাসহ সব ধরনের যানবাহনের জন্য খুলে দেয়া হয়। এর ফলে মেলায় আসা যাওয়া করা হাজার হাজার মানুষ মহাদুর্ভোগের শিকার হন। উভয় দিনই কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটে এই রাস্তায়। একই সঙ্গে রাস্তাটিতে চলে বারোয়ারি মেলা। এমন বিশৃঙ্খলা মেলার অর্জনকে যথেষ্ট ম্লান করেছে।

লেখক বলছি ॥ মেলার নির্বাচিত বই নিয়ে এবার প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় ‘লেখক বলছি’ শীর্ষক অনুষ্ঠান। এই মঞ্চে প্রতিদিন ৫ লেখক তাদের বই নিয়ে পাঠকের মুখোমুখি হন। প্রত্যেক লেখক নিজের বই সম্পর্কে আলোচনা করেন। প্রশ্নের উত্তর দেন।

সেমিনার কবিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ॥ মেলার দ্বিতীয় দিন থেকে প্রতিদিন বিকেল চারটায় বইমেলার মূল মঞ্চে হয় সেমিনার। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। চলে আলোচনা। একই সঙ্গে বিশিষ্ট বাঙালী মনীষীদের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

এবার নতুন যোগ হয় কবিতা। প্রতিদিনই ছিল কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ এবং আবৃত্তি। শিশু কিশোরদের জন্যও ছিল নানা আয়োজন। চিত্রাঙ্কন, সাধারণ জ্ঞান, উপস্থিত বক্তৃতা এবং সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় তারা। এভাবে পুরো একমাস দারুণ মুখরিত ছিল গোটা এলাকা।

এবারের মেলার মূল প্রতিবাদ্য ছিল ‘বিজয় ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ ॥ নব পর্যায়।’ তবে বিষয়টি সেভাবে সামনে আসেনি।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।