বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০৩:২৪ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
মোবাইল, ফেসবুক আসক্তিতে সর্বনাশ

প্রযুক্তি ডেক্স : আব্দুস সামী প্রিন্স। বয়স আড়াই বছরের একটু বেশি। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। বাবা পেশায় দলিল লেখক। মা গৃহিণী। বাসা চানখাঁরপুল আগামসি লেনে। প্রিন্সের বয়স যখন মাত্র ৬ মাস তখনই তার বাবা মজা করে ছেলের হাতে নিজের ফোন তুলে দেন। এরপর আরেকটু বড় হলে অতি আহ্লাদ করে ছেলেকে দামি একটি ট্যাব কিনে দেন।

সেই আহ্লাদই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোবাইলে ভিডিও দেখা ছাড়া সে কখনোই খাবার খায় না। নিজ থেকে   বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে না প্রিন্স। কারো সঙ্গে মিশে না। এমনকি ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে পর্যন্ত খেলতে চায় না। ইউটিউবে কার্টুন, বাচ্চাদের ভিডিও, মিস্টার বিনের মুখাভিনয় এসব দেখতে বেশি পছন্দ করে। তার মানসিক বিকাশ বহুলাংশেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যেটা নিয়ে তার পরিবারের সবাই খুব চিন্তিত। এই সমস্যা নিয়ে ইতিমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছেন প্রিন্সের মা।

আতিয়া। বয়স ১৮। তিন বোনের মধ্যে সবার বড়। বাবা রাজনীতিবিদ। মা গৃহিণী। যাত্রাবাড়ী দনিয়া কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ক্লাস নাইন থেকে ফোন ব্যবহার করে। ফোন তার ধ্যান-জ্ঞান। যতক্ষণ জেগে থাকেন ততক্ষণই ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে ফেসবুক বা ফোন আসক্ত বলা যায়। আতিয়া বলেন, রাত ২টা থেকে ৩টার আগে সাধারণত ঘুমানো হয় না। দিনের বেলায় ঘুম থেকে উঠি দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টায়। সারাদিনে যখনই সুযোগ পাই তখনই ফেসবুকে নিউজফিড নিয়ে ব্যস্ত থাকি। প্রত্যেকদিন গড়ে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা ফেসবুকে থাকি। মাঝে মধ্যে একটু টেলিভিশনও দেখি। বলতে গেলে ঘুম আর নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে বাকি সময়টা ফেসবুকেই থাকি।

মা আমাকে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে দেয় না। হাতেগোনা কয়েকজন মেয়ে বন্ধু ছাড়া আর কোনো বন্ধু নেই। তাই নিঃসঙ্গতা কাটাতে ফেসবুক নিয়েই পড়ে থাকি। এরই মধ্যে বাসার এক হাউজ টিউটরের সঙ্গে প্রেম হয়। এ প্রেমের স্থায়িত্ব ছিল ১০ মাস। এর কয়েক মাস পরে মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। সেটাও গত ৫ই জানুয়ারি নিজেই ভেঙে দিয়েছেন। এখন তার নিঃসঙ্গতার একমাত্র সঙ্গী ফেসবুক। সম্প্রতি বাবা-মায়ের সঙ্গে রাগ করে ২৪ ঘণ্টা নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে ছিলেন। এই পুরো সময়টাই বলতে গেলে ফেসবুকে কাটিয়েছেন। বাবা-মা বকাঝকা করায় কয়েলের স্ট্যান্ড দিয়ে নিজের হাতের বাহুর কিছু অংশ কেটে ফেলেছেন। আতিয়ার কথা- প্রায়ই মনে হয় আত্মহত্যা করি। নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যখন তখন রেগে যাই। কোনো একটা বিষয় নিয়ে এতটাই কনফিউজড থাকি যে, বাসার বাইরে যেতে কোন জামাটা পরবো সেটাও ৩ থেকে ৪ জনকে জিজ্ঞেস করে পরতে হয়। মা খুব খারাপ ভাষায় বকাঝকা করেন। যেটা আমার একদমই পছন্দ নয়। মেজো বোনের সঙ্গে সব কথা শেয়ার করি। সেই এখন আমাকে ভালো-মন্দ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে।

রাইসুল ইসলাম। ঢাকার ইসলামবাগের একটি স্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্র। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। মোবাইল ছাড়া খাবার খায় না। রাত ২টা পর্যন্ত মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে। বলতে গেলে ঘুম বাদ দিয়ে ২৪ ঘণ্টাই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অধিকাংশ দিনই সারাদিন না খেয়ে থাকে। তার মা বলেন, সপ্তাহে ৫ থেকে ৭ দিন পরে একবার গোসল করে। অনেক সময় বাবা-মা কাউকে ঠিকভাবে চিনতে পারে না। গত দুই বছর ধরে মোবাইল গেমস ও ইউটিউবের সঙ্গে সম্পৃক্ত সে। মোবাইল কেড়ে নিলে তার কিছু ভালো লাগে না।

রাত ৩টার আগে ঘুমায় না। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। মোবাইল কেড়ে নিলে বাসা থেকে টাকা নিয়ে নতুন মোবাইল কিনে। স্কুল ও কোচিং ফাঁকি দিয়ে মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে।দৈনিক প্রায় ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টা মোবাইল ব্যবহার করে।
মোবাইল, ফেসবুক আসক্তি শিশু-কিশোরসহ অনেকের মনোজগতেই আনছে বিপুল পরিবর্তন। ব্যাহত হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক জীবন, চিন্তা। এই আসক্তির ফলে আবেগ-অনুভূতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। হতাশা ও দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে। একাকী বোধ হয় ও নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করে আসক্ত ব্যক্তি। কাজের সময় ঠিকঠাক থাকে না। কাজের আগ্রহ হারিয়ে যায়। সময় জ্ঞান লোপ পায়। অসৎ পথে পরিচালিত হতে বাধ্য করে। নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করলে ঈর্ষাবোধ হতে শুরু করে। দায়-দায়িত্ব ভুলে মনোযোগ ডুবে থাকে অনলাইনে। ফলে সম্পর্ক নষ্ট হয়।

২০১৮ সালে ‘দ্যা ইন্টারনেট সোসাইটি বাংলাদেশ’-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫ কোটির বেশি। তার মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখের মতো। বাংলাদেশে ১৩-১৭ বছর বয়সী ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৭ শতাংশ। এবং ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সীদের হার ৪২ শতাংশ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ডা. মো. ফারুক আলম বলেন, ফোন বা ইন্টারনেট এডিকশন একটি রোগ। এটা আরম্ভ হয় খুব বেশি ব্যবহারের ফলে যখন নির্ভরশীল হয়ে যায়। তখন এটা তারা বন্ধ করতে পারে না। বন্ধ করলে খারাপ লাগে। কষ্ট হয়। বর্তমানে অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখতে ২ থেকে ৩ বছর বয়সেই ফোন, গেইমস-ইন্টারনেট ইত্যাদি হাতে ধরিয়ে দেন।

এতে যে বাচ্চা আসক্ত হয়ে যাচ্ছে সেটা তারা লক্ষ্য করছে না। অথচ এই বয়সে বাচ্চাদের খেলাধুলা, স্কুল, বন্ধু-বান্ধব এই বিষয়গুলো  বেশি আশা উচিত। সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা বেশি হওয়ার কথা থাকলেও সেটা কিন্তু হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সমস্যাটা হচ্ছে বাবা-মায়ের মধ্যে। তারা সন্তানদের রিক্রিয়েশনাল একটিভিটি বা খেলাধুলা এসবের বিকল্প হিসেবে মোবাইল তুলে দিচ্ছে। ফলে বাচ্চারা ব্লু হোয়েলের মতো ভয়ঙ্কর সব গেইমস খেলায় যখন আসক্ত হয়ে যায় তখন তাদের সরানো অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। এ ছাড়া এখনকার বাচ্চারা বেশির ভাগ নিজের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। যেটাকে বলা হয় অর্টিজম অর্থাৎ নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা।

তারা কারো সঙ্গে না মিশা, কারো চোখে চোখ রেখে না তাকানো, কথা না বলা, কার্টুন-মোবাইল, টিভি স্ক্রিন ইত্যাদি নিয়ে বসে থাকে। ফলে সে যখন বড় হবে তখন তার সামাজিক দক্ষতা তৈরি হবে না। সে লেখাপড়া, সামাজিক কর্মকাণ্ড সবক্ষেত্রেই দুর্বল থাকবে। ফলে ভবিষ্যতে তার সফলতাও কম আসবে। এ সমস্যা সমাধানে বাচ্চাদের হাতে একদমই মোবাইল ফোন দেয়া যাবে না। বাসায় মোবাইল ফোন বড় ভাইবোন বা বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ফোনের বিকল্প হিসেবে বন্ধু-বান্ধব, খেলাধুলা, আত্মীয়স্বজন ও জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বাইরে বেড়ানো এসব সামাজিক কর্মকাণ্ডে বাচ্চাদের উৎসাহিত করতে হবে।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।