বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৪:৪২ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
শুল্ক গোয়েন্দা নাজরদারিতে ১০০ অচল গার্মেন্টস : বন্ডেড সুবিধায় আমদানিকৃত কাপড় : তৈরি পোশাক বানিয়ে বিদেশে রপ্তানি না করে খোলা বাজারে বিক্রি : জড়িত কাস্টমস, বিজিএমইএ ,বন্দর ও সিএন্ডএফ এজেন্ট

একুশে বার্তা ডেক্স : বিনা শুল্কে বিদেশ থেকে থান কাপড় আমদানির পর পোশাক তৈরি করে আবার বিদেশে রপ্তানির কথা গার্মেন্টস মালিকদের। কিন্তু পোশাক তৈরি কিংবা বিদেশে রপ্তানি কোনোটাই না করে এসব থান কাপড় দেশের বাজারে বিক্রির মাধ্যমে অবৈধ মুনাফা করছে ১৩টি প্রতিষ্ঠান। ‘অন নো কস্ট (এফওসি) বা শুল্কমুক্ত সুবিধা’ নিয়ে এমন জালজালিয়াতির কারণে শুল্ক হারাচ্ছে সরকার।

জানা গেছে, জালিয়াতির মাধ্যমে এফওসি, ব্যাংক ও তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর কাগজপত্র বানিয়ে অচল প্রতিষ্ঠানের নামে তিন বছরে থান কাপড় আমদানি করে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। এতে সরকারের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ফেব্রিকস ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়েছেন। সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর অনুসন্ধান করে এমন ৩০০ চালানের তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে। এ ব্যাপারে গত ১১ মার্চ শুল্ক সংস্থার অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চট্টগ্রাম কার্যালয়) একেএম নুরুল হুদা আজাদ স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবেদন ঢাকায় মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজস্ব ফাঁকিতে জড়িত ১৩টি প্রতিষ্ঠান হলো : ফতুল্লা কুতুবপুরের মিসওয়ার হোসিয়ারি মিলস লিমিটেড, ঢাকা দক্ষিণখানের থ্রিএন ফ্যাশনস, খিলক্ষেতের নাব ফ্যাশনস, পূর্ব রামপুরার আশিয়ানা গার্মেন্টস, চট্টগ্রাম দানিয়ালপাড়ার ফ্যাশনস ক্রিয়েট অ্যাপারেলস, ডিকে অ্যাপারেলস, চট্টগ্রাম চট্টেশ্বরী রোডের অ্যাপারেল অপশনস, গাজীপুর চন্দনার এসআরকেএইচ ডিজাইন, টঙ্গীর জায়ান্ট গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ, ক্যাপরি গার্মেন্টস, ক্যাপরি অ্যাপারেলস, সা’দ ফ্যাশসন ওয়্যার এবং আশুলিয়া গণকবাড়ির লিয়াক ফ্যাশনস। এর বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠান নজরদারিতে রয়েছে।

শুল্ক গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানি আয় বাড়ানোর কৌশল হিসেবে শুল্কমুক্ত সুবিধায় গার্মেন্টেসের কাঁচামাল (ফেব্রিকস) আমদানির পর তৈরি পোশাক রপ্তানির সুযোগ দেয় সরকার। কিন্তু রপ্তানি আয় বাড়ানোর বদলে শুল্কমুক্ত সুবিধার পণ্য খোলা বাজারে এভাবে বিক্রিতে কাস্টমস, বিজিএমইএ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, পণ্য খালাসকারী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা একজোট হয়ে কাজ করছে।

শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো কোনোটি বন্ধ এবং কেউ কেউ ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে এ অপকর্ম করছে। তদন্ত দল সরেজমিন পরিদর্শন করে ওইসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং মেশিনারিজ অকেজো অবস্থায় দেখতে পেয়েছে।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কিংবা মালিকরা আমাদের সময়কে বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল এবং এখনো আছে। জালজালিয়াতি নয়, বৈধভাবেই তারা ব্যবসা করছেন।

এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. শহীদুল  ইসলাম বলেন, ১৩টি প্রতিষ্ঠান যে বন্ধ তার যথেষ্ট দালিলিক প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে। তাদের অভিযোগ ভিত্তিহীন। ওইসব চালানের বিপরীতে শুল্কমুক্ত সুবিধার পণ্য রপ্তানি না করে যারা রাষ্ট্রকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে তাদের শিকড় ধরতে আমাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। আশা করি থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে।

শুল্ক গোয়েন্দা বলছে, ১৩টি প্রতিষ্ঠানের আমদানি চালানের ৭০টি স্থগিত রয়েছে। চার মাসেও এসব আমদানিকারক বা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে পাওয়া যায়নি।

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিসওয়ার হোসিয়ারি মিলস লিমিটেড ৫৭টি চালানে পাঁচ লাখ কেজি ফেব্রিকস আমদানি করলেও ২০১৭ সালে কোনো পণ্য রপ্তানি করেনি। দুই বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ। ২৮ কোটি টাকা ফাঁকির অভিযোগ ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

তদন্ত অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি এফওসি সুবিধার ভুয়া প্রত্যয়নপত্রে আমদানিকৃত ফেব্রিকস খোলা বাজারে বিক্রয় করে। প্রতিষ্ঠানের মালিক বলছেন, তারা পণ্য আমদানি করেনি।

মিসওয়ার হোসিয়ারি মিলস লিমিটেডের মালিক শামীম আহমেদ শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। পণ্য আমদানি-রপ্তানিও অব্যাহত রয়েছে।

থ্রিএন ফ্যাশনসের বিরুদ্ধে তদন্তে বলা হয়েছে, ২০১৭-১৮ সালের ৩৫টি চালানের ৩২টির বিল অব এন্ট্রি দাখিল হয়নি। শুল্ককর ফাঁকি সাড়ে ১৬ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলোও তালাবদ্ধ। প্রতিষ্ঠানের নামে রপ্তানি তো দূরের কথা মেশিনারিজও নেই।

তবে থ্রিএন ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, তার প্রতিষ্ঠানও খোলা রয়েছে। তার কাছে পণ্য আমদানি-রপ্তানির সব কাগজপত্র রয়েছে।

আশিয়ানা গার্মেন্টস তালাবদ্ধ থাকলেও ২০১৫-১৭ সাল পর্যন্ত ১২৮টি চালানে ফেব্রিকস আমদানি করে ৫০ কোটি টাকা ফাঁকি দেয়। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আরিফুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ রয়েছে। আমি অনেক দিন এ কোম্পানির সঙ্গে নেই।

অনুসন্ধানী কর্মকর্তারা বলছেন, আগের বছরের রপ্তানির ওপর ভিত্তি করে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠান এ সুযোগের অপব্যবহার করে রপ্তানিমুখী কাপড় স্বল্পমূল্যে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে বিক্রি করছে। অথচ পোশাক রপ্তানির জন্য বন্ডেড ওয়্যার হাউসের তালিকাভুক্ত পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্রের বিপরীতে বিজিএমইএ থেকে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশনে (ইউডি) নির্ধারিত পরিমাণের অনুমোদন নিয়েই কাঁচামাল আমদানি করে। ইউডির বিপরীতে বন্দরে থান কাপড় খালাস এবং পোশাক তৈরির পর তা বিদেশে রপ্তানি হবে। এসব তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে সংশ্লিষ্ট কাস্টমস হাউস ও বন্ডেড ওয়্যার হাউসে।

কিন্তু এতগুলো ধাপ পেরিয়ে ভুয়া কাগজপত্রে আমদানি এবং রপ্তানি না করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয় কীভাবে? এ প্রশ্নে একজন কাস্টমস কর্মকতা বলেন, বিজিএমইএর ইউডি, বন্দর, কাস্টমস, সিএন্ডএফের প্রতিটি ধাপে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তা ছাড়া এ কাজ গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের পক্ষ একা সম্ভব নয়।

বিজিএমইএর পরিচালক মো. শহীদুল হক মুকুল বলেন, এখনকার পর্ষদ এ নিয়ে খুব সতর্ক। আমরা পরিচালকরা বসে সব কিছু যাচাই করে ইউডি দিই। অনলাইনেও ইউডি দিচ্ছি। যাতে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান দেখতে পারে।

শুল্ক গোয়েন্দার সুপারিশে বলা হয়, ইউডি যাচাইয়ে এর পাসওয়ার্ড চট্টগ্রাম বন্দরে প্রদান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সফটওয়্যারে এফওসি দলিল আপলোড, দ্রুতসময়ে ই-বন্ড রেজিস্টার, ই-পাশবুক চালুসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ই-নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থা করা জরুরি।

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।