রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৬:০৮ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
স্বাধীনতা : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

শামসুল হুদা: ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের বিভক্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্টের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান গঠিত হয় দুটি অংশে, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব বাংলা গঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে। অন্যদিকে সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব আর বেলুচিস্তান নিয়ে গঠিত হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান। জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তনের বাঙালিরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু শুরু থেকেই পাকিস্তানের শাসন-ক্ষমতা থেকে গেল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। করাচী হলো পাকিস্তানের রাজধানী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী ইসলাম ও পাকিস্তানের জাতীয় সংহতির ধুয়া তুলে বাঙালিদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ ও শোষণ শুরু করলো এবং ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে লাগল। পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে বাঙালি মুসলমানদের অবদান ছিল বেশি। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যেই এই নতুন রাষ্ট্রের চরিত্র সম্বদ্ধে তাদের মোহমুক্তি ঘটতে শুরু করলো। তারা উপলদ্ধি করতে লাগলো যে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী জাতীয় সংহতি ও ইসলামের নামে পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের অবাধ শোষণের ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তারা চক্রান্ত শুরু করলো। এর বিরুদ্ধে বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলো। বস্তুত ১৯৪৮-৫২ এই সময়ে মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এই অঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠী তাদের স্বতন্ত্র জাতিস্বত্তাকে নতুন করে আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছিল। তখন বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আত্মপরিচয় সম্পর্কে এক নতুন চেতনা জাগ্রত হলো। এই চেতনা বাঙালি হিসেবে পরিচয় সম্পর্কে চেতনা, বাঙালি জাতিসত্তা সম্পর্কে চেতনা। এই নতুন অসাম্প্রদায়িক চেতনাই ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে এই অঞ্চলের জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি। ১৯৪৮-১৯৫২ এই সময়কালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৬২-১৯৬৩ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা তথা স্বাধিকার আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ- এ সবই ছিল এক সূত্রে গাঁথা।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ ঘটেছিল বাঙালির সর্বকালের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। ঐদিন এই বাংলার সকল সম্প্রদায়ের মানুষ, সকল শ্রেণির জনগণ এক ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিতে পরিণত হয়ে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যাকে প্রতিহত করার জন্য মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছিল। পরবর্তী নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ত্রিশ লাখ শহিদের আত্মোৎসর্গ ও দুই লাখেরও বেশি মা-বোনের নির্যাতনের বিনিময়ে বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মের ফলে কেবল একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি- বলা যেতে পারে, পুনর্জন্ম হয়েছ জাতির। যে জাতি একটি ঐতিহাসিক স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত।
প্রতিবছর মহান স্বাধীনতা দিবসে আমরা অনেক আলোচনা করে থাকি। ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে, দুই লাখেরও বেশি মা-বোনের নির্যাতন ভোগে যে স্বাধীনতা অর্জিত হলো তার সুফল কতটুকু পূর্ণতা পেয়েছে- সেই সুফল জনগণ কতটুকু ভোগ করতে পেরেছে, তার মূল্যায়ন প্রয়োজন। দেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আর্থসামাজিক অবস্থার অনেক উন্নয়ন হয়েছে, তবে প্রত্যাশিত ও কাঙ্খিত উন্নয়ন হয়নি। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৭ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে আরও অনেক উন্নয়ন হবার কথা। তা হয়নি। বিগত বছরগুলোতে স্বনির্ভরতা, সোনার বাংলা, দারিদ্র্য বিমোচন, সবার জন্য শিক্ষা, একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ইত্যাদি নানান ধরনের কর্মসূচি গৃহীত হলেও ৪৭ বছরে বাংলাদেশের অর্জন আশানুরূপ নয়। এই জন্য একদিকে যেমন জনসংখ্যার আধিক্য, শিক্ষার অভাব, দাতাদেশ ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কঠিন শর্ত আরোপ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ দায়ী, অন্যদিকে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদিও কম দায়ী নয়।
স্বাধীনতার সুফল অর্জন ও তা জনগণের দ্বারে পৌঁছিয়ে দিতে হলে এসব সমস্যার সমাধানে সকলকে বিশেষভাবে সচেতন ও আন্তরিক হতে হবে। আমরা সবাই দেশের উন্নতি চাই। রাজনৈতিক দলগুলোও দেশের কল্যাণ চায় বলে প্রচার করে থাকে। তাহলে আমাদের প্রত্যাশিত উন্নতি অর্জিত হচ্ছে না কেন? এসবের কারণ খুঁজে বের করে তা দূর করতে হবে। দেশে কল্যাণকামী সকলকে, সকল রাজনৈতিক দলকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশের স্বার্থকে স্থান দিতে হবে, কথায় ও কাজে এক হতে হবে। তবেই হবে দেশের উন্নতি, তবেই হবে দেশের কল্যাণ।
লেখক: ভাষাসৈনিক (একুশে পদকপ্রাপ্ত)

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।