সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:১৮ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
শাহজালালের থার্ড টার্মিনাল : ‘প্রধানমন্ত্রী খোজখবর নেন আমার থেকে’ নতুন পিডি- নতুন প্রধান প্রকৌশলীর আমলে না পুরনোরাই বহাল থাকবেন?

নিউজ ডেক্স :  মেয়াদ শেষের আগে- মাত্র দেড় বছরেই  শাহজালালের থার্ড টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শেষে দৃশ্যমান হবে বলে জানায় সিএএবি কর্তৃপক্ষ। সংস্থা প্রধান গণমাধ্যমকে জানান, প্রধানমন্ত্রী আমার থেকে খোজখবর নেন।

এ দিকে করোনাকালিন সময়ে   স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুরোদমে চলছে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থার্ড টার্মিনালের কর্মযজ্ঞ।

ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে পুরো বেসমেন্ডের (আন্ডারগ্রাউন্ড) নির্মাণকাজ। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে টার্মিনালের মূল ভিত্তির ৩ হাজার ৪৯টি পিলার।
সে হিসাবে আগামী দেড় বছরের মধ্যেই এটি দৃশ্যমান হবে। খুলে দেওয়া হবে সাধারণ মানুষের জন্য। ভ্রমণসেবা পাবেন বছরে প্রায় দুই কোটি যাত্রী।

প্রকল্প’র পিডি তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী একেএম মাকসুদুল হক ২২ সালের জানুয়ারি পিআরএল-এ যাবেন। যদি নির্ধারিত সময়ের ৬ মাস আগে বা দেড় বছর আগে নির্মাণ কাজ শেষ হয় –তা হলে এই পুরনো  পিডিই-এর উদ্ধোধন অনুষ্ঠান করে যেতে পারবেন। আর  প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক সসম্মানে উদ্ধোন করে যেতে পারবেন।

কোন কারণে নির্মাণ কাজ পিছিয়ে যদি ২৩ সালের জুনে এর নির্মান কাজ শেষ হয় তবে নতুন পিডি নুরুদ্দির চৌধুরি । আর নতুন প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান উদ্ধোধন করবেন। আর যদি প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেকের  চাকরির মেয়াদ  এক্সটেশন হয়- তবে তার আমলেই থার্ড টার্মিনালের উদ্ধোধন হবে।

আর যদি এক্সটেশন না হয় তবে হাবিবুর রহমান প্রধান প্রকৌশলী হবেন,  বর্তমান প্রধান  প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক পিআরএল-এ যাবেন জানুয়ারি ২০২৩ সালে।

বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী বলেন, নির্ধারিত মেয়াদের আগেই স্বপ্নের থার্ড টার্মিনাল যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, করোনা মহামারি প্রতিরোধে প্রকল্পের ভেতরে প্রাথমিক চিকিৎসা ইউনিট রাখা হয়েছে। করোনা সংক্রমণ এড়াতে সবার জন্য মাস্ক ও সুরক্ষাসামগ্রী নিশ্চিত করা হয়েছে। ঢাকার দুটি হাসপাতালের সঙ্গে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার চুক্তি থাকায় আক্রান্তরা দ্রুত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। এ কারণে দ্রুত নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৩৫০ একর জমির ওপর নির্মাণাধীন থার্ড টার্মিনালে একসঙ্গে থাকবে কেবিন এক্সরে মেশিন ৪০টি, ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ, ১৬টি কনভেয়ার বেল্ট, ১১টি বডি স্ক্যানার ও টানেল। থাকবে ৫৪ হাজার বর্গমিটারের বহুতলবিশিষ্ট কার পার্কিং, নতুন ইমপোর্ট কার্গো কমপ্লেক্স ও ৬৩ হাজার বর্গমিটারের এক্সপোর্ট কার্গো কমপ্লেক্স। এছাড়া থাকবে রেসকিউ ও ফায়ার ফাইটিং স্টেশন এবং ৪ হাজার বর্গমিটার ইকুইপমেন্ট স্টেশন।

উড়োজাহাজ চলাচলের জন্য তৈরি হবে ২৪ হাজার বর্গমিটার কানেক্টিং ট্যাক্সিওয়ে (উত্তর), ৪২ হাজার ৫০০ বর্গমিটার কানেক্টিং ট্যাক্সিওয়ে (অন্যান্য) এবং ২২ হাজার বর্গমিটার র‌্যাপিড এক্সিট ট্যাক্সিওয়ে (উত্তর) ১৯ হাজার ৫০০ বর্গমিটার র‌্যাপিড এক্সিট ট্যাক্সিওয়ে (দক্ষিণ), ৯৬ হাজার ৫০০ বর্গমিটার সোল্ডার, জিএসই রোড ৮৩ হাজার ৮০০ বর্গমিটার, সার্ভিস রোড ৩৩ হাজার বর্গমিটার ও ড্রেনেজ ওয়ার্কস (বক্স কালভার্ট ও প্রোটেক্টিভ ওয়ার্কস)।

টার্মিনালের চারদিকে থাকবে নিশ্ছিদ্র বাউন্ডারি ওয়াল, সিকিউরিটি গেট, গার্ড রুম ও ওয়াচ টাওয়ার। এর বাইরে ল্যান্ড সাইড, সার্ভিস রোডসহ এলিভেটেড রোড, ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেম, সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ইনটেক পাওয়ার প্ল্যান্ট ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম, কার্গো কমপ্লেক্সের জন্য সিকিউরিটি ও টার্মিনাল ইকুইপমেন্ট, এয়ারফিল্ড গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম, হাইড্রেন্ট ফুয়েল সিস্টেমসহ আনুষঙ্গিক সব সুবিধা থাকবে। এছাড়া অন্যতম আকর্ষণ হিসাবে ফানেল টানেল রাখা হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারের অ্যাপ্রোনে একসঙ্গে রাখা যাবে ৩৭টি উড়োজাহাজ। এছাড়া থাকবে ১ হাজার ২৩০টি গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। ৬৩ হাজার বর্গফুট জায়গায় আমদানি-রপ্তানি কার্গো কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে প্রকল্পে। থাকবে ১১৫টি চেক-ইন কাউন্টার। সব মিলিয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিমানবন্দরের সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে থার্ড টার্মিনালে।

২০১৯ সালের শেষে শুরু করা নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৩ সালের  জুনে। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণে এই প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। প্রথমে ১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ধরা হলেও পরে প্রকল্প ব্যয় ৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাড়ানো হয়।

নির্মাণকাজে অর্থায়ন করছে জাইকা। আর জাপানের সিমুজি ও কোরিয়ার স্যামসাং যৌথভাবে এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম (এডিসি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। দুই দেশের চার শতাধিক দক্ষ জনবল কাজ করছেন প্রতিদিন। বিশ্বখ্যাত স্থপতি রোহানি বাহারিনের নকশায় টার্মিনালে ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের একটি ভবন তৈরি হবে।

গত বছর করোনাভাইরাসের কারণে দফায় দফায় লকডাউন আর মাটিতে পুঁতে থাকা একাধিক শক্তিশালী নিষ্ক্রিয় বোমা উদ্ধারের পরও কাজের গতিতে কোনো সমস্যা হয়নি। সিভিল অ্যাভিয়েশন বলছে, টার্মিনালের মূল ভিত্তির আন্ডারগ্রাউন্ড অংশের নির্মাণকাজ শেষ, যা কাজের ৪০ শতাংশের বেশি হবে। এখন প্রতিদিনই দৃশ্যমান হচ্ছে মূল ভবন।

হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দুটি টার্মিনালে বর্তমানে যাত্রী ধারণক্ষমতা বছরে ৬৫ থেকে ৭০ লাখ। নতুন টার্মিনাল হলে শুধু হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রায় ২ কোটি যাত্রী সেবা পাবেন।

থার্ড টার্মিনালের নির্মাণকাজ প্রসঙ্গে সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, করোনা মহামারির মধ্যেও বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের নির্মাণকাজ বন্ধ থাকেনি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুরোদমে কাজ এগিয়ে চলছে। তিনি আশা করছেন, নতুন টার্মিনালটি চালু হলে বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাতারে চলে যাবে। পুরো বিমানবন্দর হবে কম্পিউটারাইজড।

বেবিচক চেয়ারম্যান আরও বলেন, থার্ড টার্মিনালটি দেশের অন্যতম অগ্রাধিকার মেগা প্রকল্প। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের প্রকল্প। প্রতিনিয়ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টার্মিনালের নির্মাণকাজের খোঁজখবর নেন আমার কাছ থেকে। বিষয়টি মনে রেখেই সবাই নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনি জানান, নির্ধারিত সময়ের কমপক্ষে ৬ মাস আগেই নির্মাণকাজ শেষ করতে পারবেন বলে তার বিশ্বাস। নতুন টার্মিনাল চালু হলে যাত্রীদের দুর্ভোগ আর থাকবে না। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এটি।

রোববার সরেজমিন দেখা যায়, বৃষ্টি আর কাদার মধ্যেও পুরোদমে চলছে পাইলিংয়ের আন্ডারগ্রাউন্ড অংশের সর্বশেষ নির্মাণকাজ। প্রায় সব পিলার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ক্যান জিং নামের একজন জাপানি প্রকৌশলী ভাঙা ভাঙা বাংলায় যুগান্তরকে বলেন, মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাঙালিদের ড্রিম। কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। তিনি জানান, এক বছর ধরে কাজ করতে গিয়ে তারা সবাই এখন বাংলা বলতে পারেন। যার কারণে কাজ করতে গিয়ে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের দক্ষিণ পাশের রাস্তা দিয়ে ঢুকে পুরো টার্মিনালের নির্মাণকাজ দেখে খিলক্ষেতের পূর্ব পাশের রাস্তা দিয়ে বের হতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লেগেছে এই প্রতিবেদকের। ভেতরে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। সবার গায়ে হলুদ ড্রেস, মাথায় হ্যালমেট। অর্ধশতাধিক ছোট-বড় গাড়ি দেখা গেছে ভেতরের লিংক রোডগুলোয়।

বিশালাকার ক্রেনগুলো ঘুরছে একদিক থেকে অন্যদিকে। পাশে বিমানবন্দর থাকায় কিছু দূর পরপরই থাকছে বিভিন্ন সতর্কতা ও নির্দেশনা সংক্রান্ত সাইনবোর্ড।

নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও শ্রমিক-কর্মচারী ছাড়া ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ভেতরের গেটগুলোয় থাকছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পশ্চিম পাশের পুরোনো বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোনে দাঁড়ানো বিমানের ৬টি উড়োজাহাজ দেখা যায় নির্মানাধীন থার্ড টার্মিনাল থেকে। শ্রমিকরা বলেছেন, এই সৌন্দর্য তাদের কাজের শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সুক ওয়ান ক্যান নামের এক কোরিয়ান প্রকৌশলী বলেন, এতদিন নির্মাণকাজের কিছুই বাইরে থেকে দেখা যাইনি। পুরো কাজটিই ছিল আন্ডারগ্রাউন্ডে। এখন থেকে শুরু হবে বাইরের নির্মাণকাজ।

বিপ্লব কুমার নামে চল্লিশোর্ধ্ব নামে এক বাংলাদেশি শ্রমিক যুগান্তরকে বলেন, তিনি দেশে বহু বড় বড় প্রকল্পে কাজ করেছেন। কিন্তু এত টেকনিক্যাল (কারিগরি) ও সূক্ষ্ম কাজ তিনি কোথাও দেখেননি। খুশিতে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, শেখের বেটি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) না হলে এই বিশাল দালান কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াত না।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মালেক যুগান্তরকে বলেন, স্বপ্নের এই থার্ড টার্মিনালের ভেতরের ভবনটির নকশা করেছেন বিশ্বখ্যাত স্থপতি রোহানি বাহারিন। সিঙ্গাপুরের চ্যাঙ্গি এয়ারপোর্টের টার্মিনাল-৩, চীনের গুয়াংজুর এটিসি টাওয়ার ভবন, ভারতের আহমেদাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ইসলামাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো সব স্থাপনার স্থপতি ছিলেন এই রোহানি। এছাড়া মালদ্বীপ, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, ব্রুনাই, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রকল্পের নকশা করেছেন তিনি।

প্রকৌশলী মালেক আরও বলেন, থার্ড টার্মিনালের নির্মাণকাজে ব্যবহৃত প্রতিটি পণ্য যেমন ইট, বালু, পাথর, রড, সিমেন্ট, কেবল, টাইলস, পাইপসহ সব ধরনের প্রোডাক্ট আন্তর্জাতিক মানের।

পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিতে জিরো টলারেন্স (শূন্য সহিষ্ণুতা) ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত তিনি নির্মাণকাজ সরেজমিন মনিটরিং করছেন এবং নির্দেশনা দিচ্ছেন।

প্রকল্প পরিচালক বেবিচকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাকসুদুল ইসলাম বলেন, দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা টাওয়ার কিংবা সিঙ্গাপুরের চ্যাঙ্গি বিমানবন্দরের দর্শনীয় স্থাপনা যারা নির্মাণ করেছেন, তাদের হাত ধরে এখন প্রতিদিনই দৃশ্যমান হচ্ছে থার্ড টার্মিনাল।

বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মালেক যুগান্তরকে বলেন, বিশাল এই মেগা প্রকল্পটির ত্রুটি এড়াতে সবাই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে কাজ করছেন।

বেবিচক চেয়ারম্যান সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। প্রতি সপ্তাহে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাজের অগ্রগতি নেওয়া হচ্ছে। অসংগতি পেলে পরামর্শ দিচ্ছেন। যুগান্তর/ নিজস্ব সূত্র

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।