শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫৪ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
আশকোনা হজ্ব ক্যাম্প সিন্ডিকেডের কবলে : হ্জযাত্রীদের ৪০ হাজার টিকিট কালোবাজারে বিক্রি , গলাকাটা যাচ্ছে হজ্বযাত্রীদের : সউদি এয়ারের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না মন্ত্রণালয় : হজ্ব ক্যাম্পের কোটিপতি কেরানি সোহেল এখনও বহাল

একুশে বার্তা ডেক্স : হজ নীতিমালা লঙ্ঘন করে টপ টেন সিন্ডিকেটের কাছে হজের প্রায় ৪০ হাজার টিকেট কালোবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে সাউদিয়া এয়ারওয়েজ। এই সিন্ডিকেট প্রতি টিকেটে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ১০০ ডলার বেশি আদায় করে নিচ্ছে। নিরীহ হজযাত্রীরা বাধ্য হচ্ছেন অতিরিক্ত দামে টিকেট কিনতে। প্রতিবারের মতো এবারও সাউদিয়া এয়ারওয়েজ বিশেষ সিন্ডিকেটের কাছে বেশিরভাগ টিকেট বিক্রি করে অন্তত ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সব আয়োজন চূড়ান্ত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকার শীর্ষ ১০টি ট্রাভেলস এজেন্ট সিন্ডিকেট এখন দর কষাকষি করে অতিরিক্ত টাকায় টিকেট বিক্রি করছে। অথচ এবারের হজ নীতিমালায় বেশ গুরুত্ব দিয়েই এ বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে- যেই এজেন্সির কাছে হজযাত্রী আছে- তার কাছেই টিকেট বিক্রি করতে বাধ্য বিমান ও সাউদিয়া। এর ব্যতিক্রম করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমন সুস্পষ্ট নীতিমালা  সাউদিয়া এয়ার লঙ্ঘন করে চলেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নীতিমালা অমান্য করে এ সব অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্ব বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের থাকলেও এ বিষয়ে কোন নজরদারি নেই। হাব মহাসচিব শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেছেন, টিকেট নিয়ে কে কেলেঙ্কারি করছে না করছে তা দেখার দায়িত্ব বিমান মন্ত্রণালয়ের। তারা যদি ব্যবস্থা না নেয় আমাদের করার কি আছে?

এই সিন্ডিকেডের সাথে আশকোনা হজ্ব অফিসের আরো ৫ সিন্ডিকেড সদস্য জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে হজ্ব যাত্রীরা। হজ্ব যাত্রীদের অভিযোগ, আশকোনা হজ্ব ক্যাম্পে কর্মরত সহকারি হ্জ অফিসার আব্দুল মালেক কেরানি দীন মোহাম্মদ, তার  দুলাভাই সোহেল মো. ফেরদৌস, ক্যাশিয়ার খলিল নামকাওয়াস্তে এজেন্টদের মাধ্যমে টিকিট কিনার বন্দোবস্ত করে  হজ্বযাত্রীদের কাছে তা চড়া দামে বিক্রি করার কমিশনও তারা পাচ্ছেন। হজ্ব অফিসের এই ৫ সিন্ডিকেড সদস্যদের বিরুদ্ধে রিপ্লেসমেন্ট বাণিজ্য, ভিসা বাণিজ্য, এজেন্ট বাণিজ্য, লাইসেন্স বাণিজ্যসহ  অপরাধ, দুর্নীতি নিয়ে সচিবালয়ে সচিব বরাবর অভিযোগ  করা হলেও সচিব তা আমলে নেননি। এই ৫ সদস্য সিন্ডিকেড এজেন্ট বাণিজ্য নাম করে প্রতিবছর হজ্ব মওসুমে ১৪শ এজেন্ট থেকে লক্ষাধিক টাকার বাণিজ্য করছে । এই সিন্ডিকেড সদস্যদের মধ্যে কেরানি সোহেলের নামে ইসলামি ব্যাংক আশকোনা হজ্ব ক্যাম্প শাখায় ১ কোটি টাকা ও তার বউ নাজমার নামে শাহজালাল ইসলামি ব্যাংক আশকোনা শাখায়  ১ কোটি টাকাসহ ২ কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স রয়েছে বলে অভিযোগ। আর সিন্ডিকেড অন্যতম সদস্য সহকারি হজ্ব অফিসার আব্দুল মালেককে দুই দুইবার আশকোনা হজ্ব ক্যাম্প থেকে প্রত্যাহার কার হলেও তিনি আবার অাশকোনা হজ্ব ক্যাম্পে বহালতবিয়তে রয়েছেন। এই সিন্ডিকেডের বিরুদ্ধে সরকারের একজন সহকারি সচিবও লিখিত অভিযোগ করেছেন- যা আমলে নেয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে সহকারি হজ্ব অফিসার আব্দুল মালেক, কেরানি দীন মোহাম্মদ, তার দুলাভাই সোহেল মো. ফেরদৌসের সেল ফোনে কল করা হলেও রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ক্যাশিয়ার খলিলুর রহমান জানান, আমাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে সচিব বরাবর মিথ্যা অভিযোগকারি স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়া প্রধান সহকারি আব্দুর রহিমের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করা হবে।

এ দিকে সহকারি হজ্ব অফিসারসহ ৫টি পরিবারের সদস্যরা সারাবছর আশকোনা হজ্বক্যাম্পকে আবাসিক এলাকা বানিয়ে সেখানে সরকারের কোটি টাকা খরচ করে বসবাস করছে। গত ১১  জুলাই প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালের হজ্ব কার্যক্রমের উদ্ধোধনের আগে মালেক পরিবারসহ অন্যান্য পরিবারকে নিারপত্তার জন্য হজ্বক্যাম্প থেকে বের করে দেয়ার ২৪ ঘন্টা অতিবাহিত না হতেই আবার তাদেরকে হজ্ব ক্যাম্পে ওঠার অনুমতি দিয়েছেন  হজ্ব পরিচালক।

টিকিট কালোবাজারের ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মহিবুল হক জানান, ‘এ সিদ্ধান্ত সাউদিয়া মানেনি। এটা অবশ্যই আমরা খতিয়ে দেখব। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেব। এটা তারা করতে পারে না।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের হজনীতিমালায় সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে- যেসব হজ এজেন্সি বা ট্রাভেলস এজেন্সির কাছে হজযাত্রী থাকবে তারা সরাসরি বিমান ও সাউদিয়ার কাছ থেকে আনুপাতিক হারে টিকেট কিনতে পারবে। একক কোন এজেন্সি বা সিন্ডিকেটের কাছে কিছুতেই সব টিকেট বিতরণ করে সাব এজেন্টের মাধ্যমে অতিরিক্ত দাম আদায়ের জন্য জিম্মি করতে পারবে না।

এ নীতিমালা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স বিমান চাহিদানুসারে সংশ্লিষ্ট এজেন্সির মাধ্যমেই সব টিকেট বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। টিকেট নিয়ে কেউ যাতে কোন ধরনের ফায়দা লুটতে না পারে সেজন্য বিমান এবার অথরাইজ্ইড বা সাব এজেন্টের কাছেও টিকেট বিক্রি না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এতে এক এজেন্সির টিকেট অন্য এজেন্সির মাধ্যমে কিনে মাঝখান থেকে কমিশন খাওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এবারও গতবারের মতোই হজ নীতিমালার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে সাউদিয়া এয়ার বেশিরভাগ টিকেটই বিক্রি করে দেয় ঢাকার ১০টি শীর্ষ ট্রাভেলস এজেন্টের কাছে। আর বাকি যতসামান্য টিকেট বিক্রি করে বাকি ৫৬টি এজেন্সির কাছে। এ বিষয়ে সাউদিয়া এয়ারের একজন কর্মকর্তা জানান, সাউদিয়া এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার টিকেট বিক্রি করেছে- সানসাইন, আল গাজী, গোন্ডেন বেঙ্গল, ভারসাটাইল, সানজেরী, মুনা, এয়ারট্রিপ, সুরেশ্বর, কাজী এয়ার ও ইসলামিয়া নামক দশটি ট্রাভেলস এজেন্সির কাছে। শুধু সানসাইনকেই দেয়া হয়েছে ১০ হাজার টিকেট। অথচ এই এজেন্সির কাছে এক হাজার হজযাত্রীও নেই। এর বাইরে আর ৫০টি এজেন্সিকে দেয়া হয়েছে মাত্র হাজার দশেক টিকেট।

উল্লেখ্য, এ শীর্ষ এজেন্টের কাছে যে পরিমাণ টিকেট দেয়া হয়েছে তার চার ভাগের একভাগও হজযাত্রী নেই এদের কাছে। এরাই এখন সাব-এজেন্টের মাধ্যমে সব টিকেট ছেড়ে দিয়েছে ব্ল্যাক মার্কেটে। প্রশ্নটা এখানেই তাহলে কোন সাহসে তারা কোথায় কিভাবে বিক্রি করছে? হাব অফিসে গিয়ে দেখা যায় বেশকটি হজ এজেন্সির মালিক সেখানে অভিযোগ করেছেন, তাদের সাউদিয়া এয়ারের টিকেট দেয়া হচ্ছে না। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সব টিকেট তার বিক্রি হয়ে গেছে। প্রতিটি টিকেটের বিপরীতে অতিরিক্ত একশ ডলার বাড়তি গুনতে হয়েছে হজযাত্রীদের। এ নিয়ে সাউদিয়া এয়ারের প্রতিটি হজযাত্রীর সঙ্গেই এজেন্সির বাদানুবাদ হয়েছে। হজনীতিমালায় নির্ধারিত দামের চেয়ে কেন বেশি নেয়া হচ্ছে টিকেটের দাম এমন প্রশ্ন মশিউর রহমানের। তিনি গত ক’দিন ধরেই সাউদিয়ার টিকেটের জন্য বিভিন্ন এজেন্টের কাছে ধর্ণা দিয়েছেন। কোথাও পাননি। কেন টিকেটের এই সংকট তারও কোন ব্যাখ্যা নেই। তিনি বলেন, এমন অরাজকতা দেখারও কেউ নেই। হাব, আটাব, ধর্ম ও বিমান মন্ত্রণালয়েরও কেউ এনিয়ে মুখ খুলছে না। এমন দুর্নীতি করেই সাউদিয়া পার পেয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর।

কাজী এয়ার টিকেট প্রতি ১শ’ ডলার বেশি নিয়ে টিকিট বিক্রি করছে বলে হাসান নামের একজন অভিযোগ করেন।  এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল কাজী এয়ার এবার সাউদিয়া থেকে এক হাজারের বেশি টিকেট বরাদ্দ নিয়েছেন। অথচ তাদের কাছে ৪শ’ হজযাত্রীও নেই। তারপরও কাজী এয়ারকে অতিরিক্ত টিকেট দেয়া হয়েছে। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক কাজী মফিজ ক্ষুব্ধ চিত্তে বলেন,“কোথায় পেয়েছেন এসব অভিযোগ। আমাদের যতগুলো দরকার, ততগুলো টিকেটই নিয়েছি।

টপ টেন সিন্ডিকেটের শীর্ষ দাবিদার ট্রাভেল এজেন্টস সানসাইনকেই টিকেট দেয়া হয়েছে ১০ হাজার। যার কাছে হাজী নেই পাঁচশও। আল গাজীরও একই অবস্থা। টিকেট সংকটের কথা বলে এ প্রতিষ্ঠান প্রতিটি টিকেট বিক্রি করছে অতিরিক্ত ৫/৭ হাজার টাকা বেশি দামে।

গত বুধবার তদন্তে  দেখা যায় গোন্ডেন বেঙ্গল ও ভার্সাটাইল নামের এজেন্সিও নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি নিচ্ছে প্রতিটি সাউদিয়ার টিকেট। হজযাত্রী মান্নান বলেন, দুনিয়াব্যাপী হজযাত্রীরা ধর্মীয় সহানুভূতি পান। এখানে ট্রাভেলস এজেন্সিগুলো ওৎপেতে থাকে হজ মৌসুমের জন্য, যাতে হজযাত্রীদের পকেট কাটা যায়।

একটি হজ এজেন্সি জানিয়েছে, টপ টেন এজেন্টের লক্ষ্য সাউদিয়ার নিজস্ব কোটার ৬৩ হাজার ৫শ’ টিকেটের মধ্যে ৪০ হাজার টিকেট নেয়া। বাকিগুলো আর ৫০টি এজেন্সিকে দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাউদিয়া।

সাউদিয়া কেন প্রতিবছরই হজের টিকেট শীর্ষ ১০টি ট্রাভেল এজেন্টের কাছে ছেড়ে দেয় জানতে চাইলে এ নিয়ে কোন সদুত্তর দিতে পারেনি হাব মহাসচিব শাহাদত হোসেন তসলিম। বলেছেন, হজ নীতিমালা অনুযায়ী প্যাকেজে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দাম নিতে পারে না সাউদিয়া। এটা শুধু অন্যায়ই নয়, গুরুতর অপরাধ। এটা দেখার দায়িত্ব বিমান মন্ত্রণালয়ের। তারা যদি এ বিষয়ে চুপ থাকে- তাহলে আমাদের করার কি আছে? প্রতিবছরই তো তদন্তের কথা শুনি। কিন্তু কি তদন্ত হয় তা আর দেখি না। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকায় সাউদিয়া এয়ারের অফিসের শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তার যোগসাজশেই এই টপ টেন এজেন্ট প্রতিবছর হজ টিকেট কেলেঙ্কারি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। বছর চারেক আগেও হারানদা নামের এক কান্ট্রি ম্যানেজার এই কেলেঙ্কারিতে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হওয়ার পর- তাকে ঢাকা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এরপর আসেন রিয়াদ নামের আরেক কান্ট্রিম্যানেজার। তিনিও এ কেলেঙ্কারি থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি। বর্তমানের তারিক আলওয়া নামের কান্ট্রিম্যানেজারও এ অভিযোগ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি। দুর্নীতিবাজ কয়েক কর্মকর্তার পরামর্শে তিনিও টপ টেন এজেন্টের পরিকল্পনাতেই সম্মতি দেন। মূলত এই অফিসের একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবাজচক্র প্রতিবছর এই সিন্ডিকেটের কাছে একই কায়দায় টিকেট বাণিজ্য করছে।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাউদিয়ার জনৈক বাংলাদেশী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটা সাউদিয়ার নিজস্ব কৌশল। সারাবছর যেই এজেন্টগুলো ঢাকায় সাউদিয়ার টিকেট বিক্রিতে এগিয়ে থাকে- হজের সময় তাদেরই কেবল অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এদেশের হজ পলিসিতে কি আছে বা না আছে তা ধার ধারে না সাউদিয়া। তাদের বার বার মন্ত্রণালয় থেকে নোটিস দেয়া হলেও সেটার জবাব পর্যন্ত দেয় না। এমনকি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বৈঠকে সাউদিয়ার কোন প্রতিনিধিও অংশ নিতে চায় না। তারা এদেশের আইন কানুন নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছে। এটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনক এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ও কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। প্রতিবছর হজের টিকেট নিয়ে এত অনিয়ম হলেও সবাই রহস্যজনকভাবে নীরব ভূমিকা পালন করছে।

জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল বলেন, আমার কাছে কেউ এখনও এ নিয়ে কোন অভিযোগ করেনি। আগে আসুক- তারপর দেখা যাবে।

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।