শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:১৮ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
টাঙ্গাইলে কবি তারাপদ রায়ের খোঁজ মিললো আদালত পাড়াতেই, বাড়ির সামনের পুকুরটি ‘ কবি তারাপদ সরোবর ‘ করার প্রস্তাব পৗর কর্তৃপক্ষের কাছে-

কবি তারাপদ রায়। আমাদের টাঙ্গাইলের সন্তান। জন্মেছিলেন শহরের আদালত পাড়ায়। পড়েছেন বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে। ছোট বেলা থেকেই কথাগুলো শুনেছি। তারপদ রায়ের যে শহরে জন্ম, সেই শহরে আমিও জন্মেছি। যে স্কুলে পড়েছেন, সেই স্কুলে কিছু সময় আমিও ছাত্র ছিলাম। এ নিয়ে গর্ব হতো। কিন্তু আদালতপাড়ায় কোন বাড়িটি উনাদের ছিল – তা জানা ছিল না।

কয়েক মাস আগে তারাপদ রায়ের ‘চারাবাড়ি পোড়াবাড়ি’ বইটি হাতে আসে। টাঙ্গাইলের জন্য, টাঙ্গাইলের মানুষের জন্য, পিতৃপুরুষের ভিটেমাটির জন্য উনার কী হাহাকার ছিলো-বইটি পড়ে তা অনুধাবন করি।

ইচ্ছে হয় মানুষটির পৈত্রিক ভিটে দেখার। গত জানুয়ারিতে কুয়াশাচ্ছন্ন এক সকালে বের হলাম। উদ্দেশ্য তারাপদ রায়ের বাড়ি ছিলো কোনটি, তা দেখা। আদালতপাড়া কালিবাড়ী সড়কে গিয়ে দাঁড়াই। বড় কালিবাড়ীর উল্টা দিকে চায়ের দোকান। সেখানে ওই পাড়ারই ১০/১২জন বিভিন্ন বয়সের মানুষ দাঁড়িয়ে। সবাই ধুমায়িত চা পান করছেন। এগিয়ে যাই তাদের দিকে।

‘আচ্ছা, এ পাড়ায় কবি তারাপদ রায়ের বাড়ি ছিলো কোনটি? ওই যে উনার বাবা সুধীর রায় ছিলেন বিখ্যাত উকিল। তারাপদ রায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিব ছিলেন। অনেক নামকরা কবি, লেখক তিনি।’ বললাম চা খেতে থাকা লোকদের উদ্দেশ্যে।

সবাই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। দু’একজন বললেন ‘তারপদ রায়! সুধীর রায়! ঠিক চিনতে পারছি না।’ ‘হয়তো অনেক আগে ছিলো।’ ‘পুরানা মানুষদের কাছে খোঁজ করেন।’-এ ধরনের নানা কথা।

সেখান থেকে একটু এগিয়ে ফোন করলাম আমাদের শিক্ষক সরকারি এমএম আলী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সামছুল হুদা স্যারকে। তিনি জানালেন, কালিবাড়ী রোডে মৌচাক আইসক্রিম ফ্যাক্টরি ছিল, তার উল্টো দিকের গলি। ওই গলির পুকুরের উত্তরপাশেই ছিলো তারাপদ রায়ের বাবা সুধীর রায়ের বাড়ি।

চলে গেলাম ওই গলির রাস্তায়। গলির মাঝামাঝি পুকুর পাড়ে দাঁড়ালাম। ইদানিং পৌরসভা পুকুরটি দৃষ্টিনন্দন করে বাঁধিয়েছে। সুন্দর পার্কের মতো রূপ পেয়েছে পুকুরের চারপাশ। এখানে সকাল-বিকেল ডায়াবেটিক আক্রান্তরা হাঁটতে আসেন। এ জন্য অনেকে এটিকে হাস্যচ্ছলে ‘ডায়াবেটিক পুকুর’ বলেন।

যাই হোক, পুকুরের উত্তর দিকে রাস্তার ওপার একটি বহুতল ভবন থেকে এক ভদ্রলোক বের হলেন। তার সামনে গিয়ে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দাদা এ এলাকায় কবি তারাপদ রায়ের বাড়ি ছিলো কোনটি। উনার বাবার নাম সুধীর রায়। নামকরা উকিল ছিলেন।’

‘তা রা প দ রা য়, না চিনিনা। তবে শুনেছি এ পাড়ায় তারাপদ বসাক নামে একজন আছেন। তার বাড়ি কোনটা তাও জানি না।’ বলে দ্রুত চলে গেলেন লোকটি।

দক্ষিন দিকে তাকাতেই সুহাস চৌধুরীদের বহুতল ভবন দেখে মনে হলো ওর কথা। আগের ওই ভদ্রলোক হয়তো এলাকায় নতুন বসত গড়েছেন অথবা ভাড়াটিয়া থাকেন। তাই তারাপাদ রায়ের বাড়ি কোনটি ছিলো বলতে পারেননি।

কিন্তু সুহাস নিশ্চয়ই বলতে পারবে। কারন ওরা এ পাড়ার আদিবাসিন্দা। ফোন করলাম সুহাসকে। আশেপাশেই ছিলো। চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে এলো আমার কাছে।

‘এখানে তারাপদ রায়ের বাড়ি ছিলো কোনটা? উনার বাবার নাম সুধীর রায়। বিখ্যাত উকিল ছিলেন।’ একই প্রশ্ন করলাম সুহাসকে।

‘এ এলাকায় তারাপদ নামের কারো বাড়ি ছিলো বলে জানা নাই। তবে সুধীর নামে একজন আছে। কিন্তু উনিতো উকিল না। পাসপোর্ট ভিসার কাজ করতেন। স্ট্রোক করে ঘরে পড়ে আছেন কয়েক বছর ধরে।’ চোখ বড় বড় করে একদমে বলে গেলো সুহাস।

বুঝলাম সুহাসকে দিয়ে কাজ হবে না। ওর সাথে কথা বলতে বলতে চলে যাই গলির পূর্ব মাথায়। যেখানে বাকা মিয়ার ব্রীজ-বাজিতপুর সড়কে গিয়ে গলিটি ঠেঁকেছে। এসময় দেখি দক্ষিন দিক থেকে রিক্সায় একজন কবি এদিকেই আসছেন। দেখে আশান্বিত হলাম। লেখালেখি করেন, সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে জড়িত নিশ্চয়ই তিনি জানেন, তারাপদ রায়ের পৈত্রিক বাড়ি ছিলো কোনটি।

‘কবি তারাপদ রায়ের পৈত্রিক বাড়ি ছিলো কোনটি? ওই যে তার বাবা ছিলেন বিখ্যাত উকিল, নাম সুধীর রায়।’ সামনে রিক্সা থামাতেই ওই কবিকে সেই একই প্রশ্ন করলাম।

‘টাঙ্গাইল শহরের মানুষ হইয়া তারাপদ কাকার বাড়ি কোন পাড়ায় তাই জানেন না! উনাদের বাড়ি এখানে হইবো ক্যান। তারাপদ কাকার বাড়ি প্যাড়াডাইস পাড়া। জানেন না এইটা।’ অনেকটা ভৎসনা করেই ওই কবি বললেন আমাকে।

তারপর রিক্সা নিয়ে ছুটলেন নিজের গন্তব্যে। বুঝলাম কবি আমার কথা বুঝতে পারেননি। তিনি হয়তো ভেবেছেন আমি প্রাক্তন জাসদ নেতা ও এক সময়ের সঙ্গীত শিল্পী অ্যাডভোকেট তারাপদ দে’কে খুঁজছি।

পাশেই রোদ পোহাচ্ছিলেন মাঝ বয়সের একজন লোক। উপযাজক হয়ে তিনি এগিয়ে এসে আমাকে বললেন ‘ওই যে রংধনু সাইনের বিল্ডিংটা দেখছেন, ওটাই কবি মাহমুদ কামালের বাড়ি। উনার কাছে যান। বাংলাদেশ ইন্ডিয়া সব কবিদের উনি চিনেন। আপনি যার বাড়ি খুঁজছেন, তিনি নিশ্চয়ই বলতে পারবেন।’

সেদিন আর কবি মাহমুদ কামালের কাছে যাওয়া হয়নি। পরে একদিন সাধারণ গ্রন্থাগারে মাহমুদ কামালের সাথে কথা হয়। তার কাছেই জানতে পেরেছি আমি যে পুকুর পারে গিয়ে প্রথম দাঁড়িয়েছিলাম, তার উত্তর পাশেই ছিল কবি তারাপদ রায়ের পৈত্রিক বাড়ি। গলিটাতে ঢোকার দু’তিন বাড়ি পর থেকেই একেবারে পূর্বপারে বাজিতপুর রোড পর্যন্ত ছিল বাড়ি। এ বাড়িতেই জন্মেছিলেন কবি তারাপদ রায়। বিন্দুবাসিনী উচ্চ বালক বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। ১৯৫১ সালে কোলকাতায় মওলানা আজাদ কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে আইএ পাশ করার পর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে লেখাপড়া করেন। প্রথমে শিক্ষকতা করলেও পরে যোগ দেন সরকারি চাকুরিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সচিব পদ থেকে অবসর নেন।

তারাপদ রায়ের বাবা সুধীর রায় জীবিত থাকতেই আদালতপাড়ার বিশাল বাড়ির বিভিন্ন অংশ বিক্রি করেন। শেষ পর্যন্ত মুল ভিটা অবশিষ্ট ছিলো। ১৯৫১ সালে তারাপদ রায় কোলকাতা গিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি কবি হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেন। এক পর্যায়ে বাংলার প্রসিদ্ধ কবি, ছোট গল্পকার ও প্রাবন্ধিক হিসেবে জায়গা করে নেন। তাকে বলা হতো ‘বাংলা সাহিত্যে হালকা হাস্যরসের সাথে পরিমিত তিক্তরস মিশ্রনের পারঙ্গম ¯স্রষ্টা।’ তার অনেকগুলো গ্রন্থ বের হয়েছে। পেয়েছেন শিরোমনি পুরস্কার ও কথা সাহিত্য পুরস্কার।

তারাপদ রায় কোলকাতা চলে যাবার পরেও দু’চার বছর পরপরই আসতেন তার প্রিয় শহর টাঙ্গাইলে। তার বাবা আশির দশকের শুরুতেই মারা যান। পরে আদালতপাড়ার বাড়িতে বাস করতেন তার ছোট ভাই বাচ্চু রায়। বাবার মৃত্যুর পর বাচ্চু ভিটেবাড়ির শেষ অংশটুকু বিক্রি করে চলে যান। ওই জায়গায় উঠতে থাকে একের পর এক ইমারত। আর এর মধ্য দিয়েই কবি তারাপদ রায়ের পৈত্রিক বাড়ির শেষ চিহৃটুকু বিলিন হয়ে যায়।

তারাপদ রায় সর্বশেষ টাঙ্গাইলে এসেছিলেন নব্বই দশকের মাঝামাঝি। সে সময় শেষ বারের মতো দেখে গেছেন পৈত্রিক বাড়ি। তিনি হয়তো এখানে এসেই খুঁজেছেন তার শৈশব, কৈশর। হয়তো খুঁজে পাননি তিনি।

তাই হয়তো লিখেছিলেন-
‘না সেই বাড়িটা, জগৎ সংসারে আর নেই,
টুলটুলিকে কেউ চেনে না, পুরাতন শহরতলীর নতুন পীরায় বোকার মতো ঘুড়ি।’

আজ টাঙ্গাইলের বেশির ভাগ মানুষই জানেন না, কবি তারাপদ রায়ের বাড়ি ছিলো কোনটি। অথচ বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে টাঙ্গাইলের পরিচিতি মেলে তারাপদ রায়কে দিয়ে। এই মানুষটির স্মৃতি রক্ষায় টাঙ্গাইলবাসীর কি কিছুই করার নেই। তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে কিছু কি করা যায় না। তার পৈত্রিক ভিটার সামনেই সুদৃশ্য একটি পুকুর রয়েছে। এটি কি ‘কবি তারাপদ সরোবর’ নামকরন করা যায়। পৌর কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারেন।

তিনি ২০০৭ সালের আগস্ট মাসের ২৫ তারিখে প্রয়াত হন।

(লকডাউনে রচনা)

লেখাটি দৈনিক  প্রথম আলোর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি কামনাশীষ শেখরের ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া/ঘাটাইল ডটকম

তারাপদ রায়ের সাহিত্য রচনা

বাল্য অবস্থা থেকেই কবিতা রচনা করে গেছেন তিনি। তার প্রথম কবিতার বই ‘তোমার প্রতিমা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। তার প্রকাশিত কবিতা সহস্রাধিক। কবিতার পাশাপাশি লিখতেন রম্যরচনা তাছাড়াও লিখেছেন অজস্র সঙ্গে গল্প, ছোট উপন্যাস ও শিশু সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যে সার্থক রম্যরচয়িতাদের মধ্যে পাঠক পাঠিকাদের মধ্যে তিনি ভালো ভাবেই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি ‘নক্ষত্র রায়‘ এবং ‘গ্রন্থকীট‘ ছদ্মনামেও লিখতেন। সরকারি অতিথি হয়ে ঘুরেছেন ইংল্যান্ড, আমেরিকা সহ বহু দেশে।

উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহ

  • ক খ গ ঘ (১৯৯৬), কাণ্ডজ্ঞান, বিদ্যাবুদ্ধি, জ্ঞানগম্যি, বুদ্ধিশুদ্ধি, শোধবোধ (১৯৯৩), জলভাত, গঙ্গারাম, পটললাল, সর্বাণী, বলা বাহুল্য (২০০০), বালিশ, কী খবর, ধারদেনা, ঘুষ, রস ও রমণী, শেষমেষ, সরসী, জলাঞ্জলি, সন্দেহজনক, বাঁচাবার, স্ত্রী রত্ন, মেলামেশা, মারাত্মক, ভদ্রলোক, বানরেরা মানুষ হচ্ছে, ডোডো তাতাই পালাকাহিনী, ছাড়াবাড়ী পোড়াবাড়ী, টমটমপুরের গল্প, দুই মাতালের গল্প ও অন্যান্য, ভাগাভাগি (১৯৯৭, সর্বনাশ (২০০১)।

কবিতার বই

  • তোমার প্রতিমা (১৯৬০), ছিলাম ভালবাসার নীল পতাকাতে স্বাধীন (১৯৬৭), কোথায় যাচ্ছেন তারাপদবাবু (১৯৭০), নীল দিগন্তে এখন ম্যাজিক (১৯৭৪), পাতা ও পাখিদের আলোচনা (১৯৭৫), ভালোবাসার কবিতা (১৯৭৭), দারিদ্র্যরেখা (১৯৮৬), দুর্ভিক্ষের কবিতা, জলের মত কবিতা (১৯৯২), দিন আপনি দিন খাই (১৯৯৪), টিউবশিশুর বাবা (১৯৯৫, ভালো আছো গরীব মানুষ (২০০১), কবি ও পরশিনী (২০০২)

তারাপদ রায় শিরোমণি পুরস্কার ও কথা পুরস্কার (১৯৯৫) এ ভূষিত হয়েছেন।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।