বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১০:১৩ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
পেঁয়াজে রাতের ভেলকি : মিনিটে মিনিটে বাড়ছে দাম, সিন্ডিকেডের শাস্তি দাবি

ডেক্স রিপোর্ট : পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের এক রাতের ভেলকি দেখল দেশ। যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই শুধু অতিরিক্ত মুনাফা লুটতে এই সিন্ডিকেটের অদৃশ্য কারসাজিতে আগের দিনের ১৬০ টাকা কেজির পেঁয়াজ ৯ ডিসেম্বর  শনিবার সারা দেশে দাম উঠেছে ২০০-২২০ টাকা পর্যন্ত। যদিও প্রতি কেজি পেঁয়াজে আমদানিকারক বা পাইকারি ব্যবসায়ীদের খরচ পড়েছে ৯০ টাকা। আমদানি ও দেশি পুরোনো পেঁয়াজের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার সুযোগে বাজারে নতুন আসা মুড়িকাটা পেঁয়াজেরও দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। হঠাৎ করে এই দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ দেখছে না সরকারও। ভোক্তারাও বুঝতে পারছেন, এটি পুরোপুরি সিন্ডিকেটের কারসাজি। তারা জড়িত এই সিন্ডিকেটকে দ্রুত শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনারও দাবি তুলেছেন। বাজার বিশ্লেষকরা বলেছেন, দায়ীদের কঠোর শাস্তি না হলে এই অস্থির সময়ে যখন-তখন যে কোনো পণ্য ধরে বাজার অস্থির হয়ে উঠতে পারে। ৯ ডিসেম্বর বাজারে পিয়াজের দাম বাড়ছে মিনিটে মিনিটে।ক্রেতারা দিশেহারা।

ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় দেশের বাজারে তাৎক্ষণিকভাবে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে বলে মনে করেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর বাংলাদেশকে ৭ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে। তবে দুই দেশের সরকারের মধ্যে দরকষাকষির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি করা যেতে পারে। এরই মধ্যে আমরা দিল্লির সঙ্গে কথা বলেছি। দ্বিপক্ষীয় সেপা চুক্তিতেও বিষয়টি রাখা হয়েছে। সে অনুযায়ী আমদানির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার চেষ্টা চলছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৭ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক শাখা থেকে পেঁয়াজ রপ্তানির নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ তিন মাস বাড়ানোর খবর চাউর হওয়ার পর সিন্ডিকেট পণ্যটির দাম বাড়ানোর এই প্রতিযোগিতায় নামে, যা গত ৮ ডিসেম্বর শুক্রবার থেকে কার্যকর হয়। গত ২৯ অক্টোবর ভারতে প্রতি টন পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য ৮০০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়, যার মেয়াদ ছিল এ মাসের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

যদিও এর যৌক্তিক কোনো কারণ দেখছে না কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তারা বলেছে, গত ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে ৬ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এখন পেঁয়াজের মৌসুমও শুরু হয়েছে। ফলে পেঁয়াজের বাজারে এই অস্থিরতার তৈরি হওয়ার কোনো কারণ নাই। তারা আশা করছে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

অন্যদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাঠ তথ্য বলছে, ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেও বাজারে পুরোনো দেশি পেঁয়াজ ও আমদানি পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে মজুত পেঁয়াজ দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি করা হয়েছে। অন্যদিকে পাবনা ও ফরিদপুর অঞ্চলের মুড়িকাটা নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করেছে। কৃষকরা প্রতি মণ মুড়িকাটা পেঁয়াজ ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন বলে জানা গেছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (বাজার সংযোগ-১) প্রণব কুমার সাহা কালবেলাকে বলেন, ‘ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হলেও দেশের মুড়িকাটা পেঁয়াজ তোলা শুরু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের (মিগজাউম) কারণে গত দু-তিন দিন টানা বৃষ্টির কারণে কৃষকদের একটু সমস্যা হলেও আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বাজারে পর্যাপ্ত মুড়িকাটা পেঁয়াজ আসবে। ফলে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা থাকবে না।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস কালবেলাকে বলেন, ‘দেশে এখন মুড়িকাটা পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছ। ফলে আমরা সংকটকাল পার করে ফেলেছি। এর আগে বাজার সংকট মোকাবিলায় ১৯ লাখ পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬ লাখ ৯৭ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে বলে জানি। ফলে যে পরিমাণ ঘাটতি, তার কাছাকাছি আমদানি হয়ে গেছে। বাজারে সংকট থাকার কোনো কারণ নেই।’

ঢাকার শ্যামবাজারের একজন ব্যবসায়ী জানান, ভারত পেঁয়াজ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এতেই বাজার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। যাদের কাছে আগের মাল আছে, তাদের অতিরিক্ত কোনো টাকা খরচ করতে হয়নি। কিন্তু সুযোগ পেয়ে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঢাকার শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতির সভাপতি হাজী মো. সাঈদ কালবেলাকে বলেন, ‘বাজারে পেঁয়াজ নেই। যারা আড়তে সরবরাহ করবে, তারা মাল দিচ্ছে না।’

পেঁয়াজের দাম হঠাৎ অস্বাভাবিক চড়ার খবর পেয়ে সারা দেশের বিভিন্ন বাজার ও আড়তে ৫৭টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ১৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে মোট ৬ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা জরিমানা করেছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান কালবেলাকে বলেছেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এ অভিযানের কার্যক্রম চলবে।’

আমদানিকারকরা বলছেন, ডলার সংকট দেখিয়ে ১০০ ভাগ অর্থ দিয়েও ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না তারা। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোকে সহজ শর্তে এলসি খোলার নির্দেশনা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

৯ ডিসেম্বর শনিবার ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেশি পেঁয়াজ সর্বোচ্চ ২২০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। আগের দিন দেশি পেঁয়াজ ১২০ থেকে ১৩০ টাকা এবং আমদানি পেঁয়াজ ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক দিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৮০ থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, মোকাম বা আড়তে দাম বৃদ্ধির কারণে তাদেরও বাধ্য হয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৭ থেকে ২৮ লাখ টন। দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ৩৫ লাখ টনের বেশি। এর মধ্যে উৎপাদনের পর প্রক্রিয়াজাত, পরিবহন ও সংরক্ষণ ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়। ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে শুধু রোজার মাসে পেঁয়াজের চাহিদা সাড়ে তিন থেকে ৪ লাখ টন। ফলে রোজার মাস ছাড়া বাকি ১১ মাসে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন। সে হিসাবে প্রতি মাসে চাহিদা ২ লাখ ১৮ হাজার ১৮১ টন। আর দৈনিক চাহিদা ৭ হাজার ২৭২ টনের মতো।

বাজার ও আমদানি পরিস্থিতির সম্পর্কে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ কালবেলাকে বলেন, ‘ভারতের সিদ্ধান্তের কারণে এলসি করা নতুন মাল আসা বন্ধ আছে। তবে এই সিদ্ধান্তের আগে নিষ্পত্তি হওয়া এলসির মাল আগামী সোমবারের মধ্যে দেশে চলে আসবে। এর বাইরে ভারত থেকে আপাতত আর পেঁয়াজ আসার সম্ভাবনা নাই।’

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, ভারত থেকে রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পর পরই দেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র খাতুনগঞ্জের আড়তগুলো থেকে পেঁয়াজ উধাও হয়ে গেছে। ফলে এখানকার পাইকারি বাজারেও বেচাকেনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভারতের বাইরে অন্যান্য বিকল্প বাজার থেকে পেঁয়াজ আমদানির পরামর্শ দিয়েছেন আড়তদাররা।

খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লা মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. ইদ্রিস কালবেলাকে বলেন, ‘খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে পেঁয়াজ নাই। যাদের কাছে আছে সেগুলোও বিক্রি হয়ে গেছে। এছাড়া ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানের ভয়ে অনেক ব্যবসায়ী বাড়তি দামে পেঁয়াজ আড়তে তুলতে চাচ্ছে না। ভারত তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তে বাজার বন্ধ করেছে। এতে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু কথা হলো নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসতে আরও ১০ থেকে ২০ দিন লাগবে। এর আগে যে পেঁয়াজ আছে তা দিয়ে চলবে না। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ, ব্যাংক যাতে ১০ শতাংশ মার্জিন দিয়ে এলসি খোলার সুযোগ করে দেয়। এখন ১০০ ভাগ মার্জিন দিয়ে এলসি করা লাগছে। ডলার সংকটের কথা বলে ব্যাংক এলসি দিচ্ছে না। অন্যদিকে কাঁচামাল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনার কারণে ব্যবাসায়ীরাও ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। এর মধ্যে ১০ ভাগ মার্জিনে হলে ব্যবসায়ীরা বিকল্প বাজার থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিতে পারবে। তিনি বলেন, সমস্যার মূল্যে গিয়ে সংকট সমাধানের চিন্তা করতে হবে। এ ছাড়া ভোক্তা অধিদপ্তর বা ব্যবসায়ীদের জরিমানা ও তদারকি করে কিছু হবে না।’

সিলেট ব্যুরো জানায়, জেলার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। তবে কোথাও কোথাও ২২০ টাকায়ও মিলেছে পেঁয়াজ।

বগুড়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, এক রাতের ব্যবধানে বগুড়ায় দেশি পেঁয়াজের পাইকারি দাম কেজিতে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে, যা খুচরা বাজারে ওই পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকায়। কালবেলা

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।