রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৪ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
আওয়ামীলীগ নেতা আমিনুলের দাপট! গোটা রামপুরায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম : ১১ বছর ধরে মালা দাসের সম্পত্তি দখল : এমপির জায়গাও দখল! খুটির জোর কোথায়?
আমিনুল, মিঠু ও ভুক্তভোগী মালা দাস। (ছবিতে বাঁ থেকে)

নিউজ ডেক্স : পুরো রামপুরায় আওয়মীলীগের রাজনৈতিক পরিচয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলছে আমিনুল, মালা দাসের জমি ১১ বছর দখল করে আছে, এমপির জায়গাও দখল করেছে। তার খুটির জোর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এলাকাবাসি। এ নিয়ে যুগান্তরে বিস্তারিত প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদওেন বলা হয়েছে,

রাজধানীর রামপুরা থানার ৯৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম। রামপুরার সর্বত্র রয়েছে তার বিশাল ক্যাডার বাহিনী। এই ওয়ার্ডের আওতাধীন এলাকায় বাড়ি নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই আমিনুল বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে অন্যথায় বারবার বাধার মুখে পড়তে হবে বাড়ির মালিকদের।

আমিনুল ইসলামের ‘অনুমতি’ পাওয়ার পর রাতারাতি দূর হয়ে যাবে সব ‘বাধা’। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগীদের কাছে ‘অনুমতি’ পাওয়ার নেপথ্যের কথা জানতে চাইলে তারা আক্ষেপের সুরে বলেন, কুমিরের মুখের সামনে থেকে এত কথা বলা যায় না। অন্যদিকে যারা তাদের চাহিদামতো চাঁদা দেবে না তাদের ওপর শুরু হয় নানান অত্যাচার।

মালা দাস নামের একজন বাড়ির মালিক বলেন, আমার জমি এই আমিনুল ইসলাম ২০১১ সাল থেকে দখল করে রেখেছেন। এই সম্পত্তি দখল করার সময় আমার ঘরবাড়ি ভাঙচুর এবং স্বামী-সন্তানকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে হাত-পা ভেঙে ফেলে যা তৎকালীন সময়ে পত্রিকাসহ টিভি চ্যানেলেও প্রচার হয়েছিল। বর্তমানে আমার সন্তানরা চিকিৎসা করে সুস্থ থাকলেও আমার স্বামী প্যারালাইসড হয়ে বিছানায় আর আমি টিউশনি করে সংসার চালাই। আমার সাজানো সংসারটা তছনছ করে ফেলছে এই আমিনুল বাহিনী। এ ব্যাপারে মামলা এবং কয়েকটি দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও দখলমুক্ত করতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, এই আমিনুল ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি হওয়ার পর থেকেই এলাকার অসহায়দের ওপর দোজখ নেমে এসেছে। তার এতটাই ক্ষমতা সে একজন সংসদ সদস্যের জায়গাও ভুয়া কাগজ বানিয়ে দখল করে রেখেছে। তার খুঁটির জোর কোথায়?

যতসব অভিযোগ : এছাড়া এলাকার প্রধান সড়কের দুই পাশে বাজার বসিয়ে এবং ব্যাটারিচালিত রিকশার টোকেন বাণিজ্য করে মাসিক প্রায় ২০ লাখ টাকা আদায় করে এই আমিনুল বাহিনী। পূর্ব রামপুরা, পশ্চিম রামপুরা, উলন ওমর আলী লেন, নাসিরের টেক, বাগিচার টেক, দাসপাড়া, মহানগর আবাসিক এলাকা, বনশ্রী আবাসিক এলাকার কিছু অংশ ও মোল্লাপাড়ায় বেশ কয়েকদিন ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলাকার সর্বত্র আমিনুল ইসলাম ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। নতুন বাড়ি তোলার আগে অবশ্যই তার সম্মতি নিতে হয়। সেজন্য দিতে হয় মোটা অঙ্কের চাঁদা।

এছাড়া জমি ও বাড়িদখল, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ এবং বিচার-সালিশের নামে টর্চার সেল চালানোর অভিযোগও পাওয়া গেছে এই আমিনুল বাহিনীর বিরুদ্ধে। এলাকার লোকজনের অভিযোগ, আমিনুল ইসলামের যাবতীয় অপকর্মের অন্যতম সহযোগী চিহ্নিত অপরাধী কারাবন্দি রামপুরার শীর্ষ সন্ত্রাসী কাইল্যা পলাশের ভাই ইউনিট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জামশেদ খান মিঠু ওরফে তারছিড়া মিঠু, ছাত্রদলের সাবেক নেতা হিমেল, কালাম, রফিক, টাকলা বাবু, আকাশ, রমজান ও প্রান্ত।

তাদের মধ্যে রমজান নিয়ন্ত্রণ করেন মাদকের কারবার। তারছিড়া মিঠু প্রায়ই এলাকার বিভিন্ন প্রতিবাদী মুরব্বিদের চড়-থাপ্পড় দিয়ে রাস্তাঘাটে অপমান করে, যাতে করে আমিনুলকে নিয়ে সবার ভেতরে আতঙ্ক বিরাজ করে। এ ব্যাপারে স্থানীয় তাজুল ইসলাম বলেন, এই গ্রুপটির বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই তাদের ওপর চলে হামলা। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী শফিকুর রহমান বলেন, রামপুরাতে ব্যবসা করতে হলে আমিনুল ইসলামকে চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতে হবে, এর বাইরে গেলেই আমার মতো অমানুষিক মাইর খেতে হবে। আমি তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করেছি, যার তদন্ত করছে সিআইডি।

একাধিক দিন ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ভুক্তভোগীদের নানা অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। তবে আমিনুলের লোকজন এতটাই বেপরোয়া যে, তাদের অপকর্ম নিয়ে মুখ খুলতেও ভয় পান সবাই। কেউ কেউ কথা বলেছেন নাম-পরিচয় গোপন রেখে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, একাধিক মামলার আসামি থাকা সত্ত্বেও তাকে কীভাবে ওয়ার্ডের সেক্রেটারি করা হলো। শুনেছি এবার সে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে সভাপতির পদ বাগিয়ে আনার লবিং করছেন। তাদের মতো অপরাধীদের হাতে যদি এভাবে ক্ষমতা দেওয়া হয় তবে তা দলের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।

অবশ্য রামপুরা থানা আওয়ামী লীগ নেতা এবং ওই ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা মীর আলিম যুগান্তরকে বলেন, এলাকাটি পুরোপুরি অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। যারা এসব অপরাধ দমন করবেন, তারাই যদি এসবের নেতৃত্বে থাকেন-তাহলে কী অবস্থা হয়, তা এলাকার বাসিন্দারা টের পাচ্ছেন। দখল, চাঁদাবাজি আর মাদক-সব অপরাধই আছে ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডে। ভুক্তভোগীদের একজন বলেন, আমিনুলের কাছে কেউ জায়গা-জমিসংক্রান্ত বিচার-সালিশ নিয়ে গেলে তিনি আগে দলিল দেখতে চান। দলিলে ঝামেলা থাকলে তিনি আগ্রহ দেখান। ওয়ারিশদের মধ্যে ঝামেলা লাগিয়ে তিনি একটা অংশ নামমাত্র মূল্যে লিখে নেন। বিচারপ্রার্থী দুর্বল হলে শেষ পর্যন্ত ওই জমি গ্রাস করে নেন তিনি।

এর বাইরে কাঁচাবাজারের নিয়ন্ত্রণও আমিনুল ও তার লোকজনের হাতে। বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বাজারে ৩ শতাধিক অস্থায়ী দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক চাঁদা নেয় আমিনুলের লোকজন।

বিশেষ কমিটি : এলাকার লোকজন জানান, আমিনুল ইসলাম পুরো এলাকায় তার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে বিভিন্ন মহল্লায় তার অনুসারীদের দিয়ে বিশেষ কমিটি করেছেন। অলিগলিতে দোকান ভাড়া করে বানানো হয়েছে এসব কমিটির ক্লাব। এসব গলি কমিটি তদারকি করেন তারছিড়া মিঠু। কমিটির কাজ হচ্ছে, এলাকায় কেউ আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বললেই তা প্রতিরোধ করা। কোনো গলিতে নতুন বাড়ির কাজ শুরু হলে তা নজরে আনে ওই কমিটির সদস্যরা।

কোনো বাড়িতে বিদ্যুৎ, পানি বা গ্যাসলাইন লাগলেও গলি কমিটি তা তদারকির দায়িত্ব নেয়। সব কাজেই তাদের চাঁদা দিতে হয়। এলাকার লোকজনের কাছে এই মহল্লা কমিটি এক আতঙ্কের নাম। কারণ কমিটি যেভাবে চায়, তা না হলে এলাকাবাসীর ওপর নেমে আসে নির্যাতন। বিচার-সালিশের নামে ক্লাবে ধরে নিয়ে টাকা আদায় থেকে শুরু করে নির্যাতনও চালানো হয়।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিঠু ছাড়াও মহল্লা কমিটিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে পারভেজ, হিমেল ও রাশেদ। রাসেল নামের এক সন্ত্রাসীও এই কমিটির অন্যতম সদস্য। সালিশের নামে নির্যাতনের প্রায় সব ঘটনায় এই রাসেলের সরব উপস্থিতি দেখা যায়। জানা গেছে, পুরো এলাকায় মাদক বিক্রির জন্য একটি কিশোর গ্যাং গ্রুপও রয়েছে তাদের সহযোগী হিমেলের। ওই দলে ১৫-২০ জন রয়েছে। যাদের সবার বয়স ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। এ গ্রুপটি এলাকায় মাদক বিক্রি করে থাকে। ওয়ার্ডের বাসিন্দা কালাম আজাদ বলেন, গোটা এলাকাটি যেন মাদকের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এখানে ভালোভাবে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

আমিনুল টাকার বিনিময়ে ৯৮নং ওয়ার্ড কমিটি ও ইউনিট কমিটিতে মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী, অনুপ্রবেশকারী সরকারবিরোধী ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন। আরও মজার ব্যাপার হলো, আমিনুল নিজেও এক সময় ছাত্রদল ও যুবদলের সক্রিয় রাজনীতি করতেন। এখনো তার পরিবারের সবাই ও আত্মীয়স্বজনরা বিএনপির সক্রিয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়াসহ অর্থ জোগানদাতা হিসেবে পরিচিত।

এ ব্যাপারে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি বলেন, অনৈতিকভাবে কোনো সন্ত্রাসীকে কমিটিতে রাখা হবে না এবং যদি ত্যাগী নেতাও হয় কিন্তু ইদানীং বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদেরও বাদ দেওয়া হবে। গ্রহণযোগ্যহীন এবং চিহ্নিত অপরাধীদের আমরা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেই না এবং তাদের নেতাও বানাব না। তারা যদি নাম ভাঙিয়ে চলে সেই বিষয়েও আমরা সতর্ক রয়েছি । প্রয়োজনে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।

অভিযুক্ত আমিনুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা আমার কোনো বাহিনী নেই। মালা দাসের জায়গা আমি দখল করিনি, উল্টো সে আমার জায়গা দখল করে রেখেছে। আমার জায়গায় আমি বিল্ডিং করেছি, এমপি জমি নিয়ে মামলা করে হেরে গেছে।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।