রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:২৯ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
„ঢাকা বিমানবন্দর থেকে এক যাত্রীর বাসায় পৌঁছানোর কাহিনি : ইমিগ্রেশন- কাস্টসের পুলসিরাত পার হতে পারলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেন

রিয়াদ মেহেদী হাসান : ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক (সাইনবোর্ডে তাই লেখা!) বিমানবন্দর আছে। কিন্তু এটাই দুনিয়ার একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যার সঙ্গে গণপরিবহনের কোনোই যোগাযোগ নেই! না আছে সিটি বাস সার্ভিসের কোনো ব্যবস্থা, না আছে কোনো ট্রেনসেবার কোনো ব্যবস্থা।

কারণ, বাংলাদেশে যাঁরা বিমানবন্দর ব্যবহার করেন, তাঁদের সবার সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে এবং সবাই প্রাইভেট গাড়িতে বিমানবন্দরে যাওয়া-আসা করেন, সবাই ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে একটি দেশি মুরগি কিনে খান! তাই কোনো গণপরিবহনের দরকার পড়ে না!

অনেকেই বলবেন, কেন, ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন তো আছে!
হ্যাঁ, তা আছে। ৮ থেকে ১০ বা ২০ থেকে ২২ ঘণ্টার ভ্রমণ করে দুই-তিনটা স্যুটকেস নিয়ে, অথবা বড় বড় দুটি বস্তা নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে ওগুলো মাথায় নিয়ে পৌনে এক কিলোমিটার হেঁটে ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত সড়ক পার হয়ে ওই স্টেশনে যদি জান নিয়ে, সব মাল নিয়ে পৌঁছাতে পারেন, তাহলে বলা যায় আপনি একজন সুপার হিউম্যান!

এই বিমানবন্দরে নামার পর সব ধরনের বালামুসিবতের দোয়া পড়ার পর যদি ইমিগ্রেশন কাস্টমসের পুলসিরত কোনো ঝামেলা ছাড়াই পার হতে পারেন, তবে আপনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে পারেন। তবে কাস্টমস থেকে বের হয়ে যেখানে গাড়িতে উঠবেন, ঠিক সেখানে নিজেকে আবিষ্কার করবেন যে আপনি আসলে ‘খাঁচা’য় বন্দী! এ খাঁচার ভেতর ১০ থেকে ১২টি গাড়ি ঢুকতে পারে মাত্র যাত্রী নেওয়ার জন্য। স্বভাবতই, বিদেশ থেকে যাঁরা আসেন, তাঁদের সঙ্গে অনেক বোস্কাবাস্কি থাকে। এ কারণে গাড়িতে উঠতে বেশ সময় লাগে। ফলে এই খাঁচার মধ্যে গাড়ি সহজে ঢুকতে পারে না, যেহেতু গাড়ি রাখার জায়গা নেই।

আপনাকে নিতে আসা গাড়ির চালক খাঁচার বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে আধা ঘণ্টা মাত্র ১০০ গজ দূরে আপনাকে নেওয়ার জন্য। এইটা এমন একটি খাঁচা যে আপনি নিজে হেঁটে গেটের বাইরে গিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যেতে পারবেন না, কারণ, ওয়ানওয়ে সিস্টেম। যে গাড়ি একবার এই লাইনে ঢুকছে, তাকে এই খাঁচা দিয়েই বের হয়ে যেতে হবে, এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।

দীর্ঘ যাত্রা শেষে আপনি হয়তো টয়লেটে যাওয়ার চাপ অনুভব করছেন, কিন্তু কোনো উপায় নেই। আপনাকে ব্যাকসাইডের মাসল শক্ত করে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আর একবার যেহেতু বেরিয়ে এসেছেন, তাই বিমানবন্দরে ভেতরেও ঢুকতে পারবেন না কাজ সারার জন্য! তাহলে এই ‘খাঁচা’কেন বানিয়েছে, যেখানে মানুষের এত ভোগান্তি! এখানেই আমাদের জাতীয় চরিত্রের প্রথম ছাপ দেখতে পাবেন! আমরা জাতিগতভাবে কী, তার প্রমাণ হলো এই খাঁচা। এই খাঁচা যদি না বানাত, তবে কোনো বিদেশফেরত যাত্রী তাঁর মালসামানা নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারতেন না। এই খাঁচা ঢাকা বিমানবন্দরে খুব জরুরি, নইলে কোনো প্রবাসী দেশে ফিরে বাড়িতে পৌঁছতে পারবেন না।

যা-ই হোক, আপনি স্রেফ গরমে দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত হয়ে একসময় নিজের গাড়িতে উঠতে পারলেন, কিন্তু একচুল আগাতে পারবেন না! কারণ, আপনার গাড়ির সামনে আরেক চালক রাস্তা ব্লক করে একটি মিনিবাসভর্তি আত্মীয়স্বজন নিয়ে তাঁদের সৌদিফেরত জামাইকে রিসিভ করতে এসেছেন। সাত সিটের মাইক্রো থেকে একে একে ২০ জন বের হয়ে জামাইকে ফুল দিচ্ছেন, গ্লাসে গরম দুধ খাওয়াচ্ছেন, মিষ্টি মুখ করাচ্ছেন!

আপনি তো আর এই সামাজিক কালচারে ব্যাঘাত ঘটাতে পারেন না, আপনাকে অধীর ধৈর্যসহকারে গাড়িতে বসে থাকতে হবে। আর কানের কাছে আনসারের বাঁশির তীব্র আওয়াজ শুনতে হবে। যাক, এরপর কোনো একসময় খাঁচা থেকে বের হলেন, ভাবলেন, এবার বুঝি রেহাই! কিন্তু না, ভোগান্তি মাত্র শুরু! আন্তর্জাতিক একটি বিমানবন্দর, কিন্তু এর থেকে বের হয়ে মেইন রোডে উঠতে পারবেন না! চোখের সামনে অনেক রাস্তা এবং গাড়িও আস্তে আস্তে চলছে, কিন্তু মেইন রোডে উঠতে পারবেন না। কারণ, আগের সেই গোলচক্করে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ, বিমানবন্দরের উন্নয়নের কাজ চলছে।

বিমানবন্দর তো রাস্তার কাজ হতেই পারে, কিন্তু যাত্রী বাইরের যাওয়ার রাস্তা নেই, আছে গোলকধাঁধা! সামনের কয়েকটি গাড়ি যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকে আমাদের চালকও যাচ্ছেন বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার জন্য। কারণ, কে কোনদিকে যাচ্ছে কেউ জানে না। তো এক জায়গায় এক ছাতার নিচে দাঁড়ানো নিরাপত্তারক্ষীকে দেখে জিজ্ঞাসা করা হলো, কার্গোর দিক দিয়ে কি বের হওয়া যাবে? তিনি কোনো কথা না বলে শুধু মাথা নাড়লেন, বুঝলাম তাঁর কোনোই গরজ নেই, আপনি বের হতে পারেন বা না পারেন।

কার্গোর দিকে কিছু দূর যাওয়ার পর দেখা গেল আরেক পুলিশ সব গাড়িকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। অগত্যা আমাদের গাড়ি ঘুরে আবার সেই গোলকধাঁধার ভেতর ফেরত এল।
এবার ডমেস্টিক এয়ারপোর্টের দিকে অন্য গাড়িগুলো যাচ্ছে দেখে আমাদের গাড়িও যেতে লাগল। কিন্তু লম্বা লাইন, গাড়ি বাম্পার টু বাম্পার, গাড়ি নড়নচড়নের কোনো উপায় নেই। কিছু সময় এভাবে পার করার পর, আমাদের গাড়িচালক রোড-কোনো দিয়ে রাস্তা বন্ধ করার ফাঁক গাড়ি ঢুকিয়ে অজানা উদ্দেশে রওনা দিলেন। মনে মনে ভাবছি, নির্ঘাত ওখানে গিয়ে দেখব রাস্তা টোটালি বন্ধ, সবাইকে আবার ঘুরে এখানেই আসতে হবে। যা-ই হোক, চালক কয়েকটি খানাখন্দ পার হয়ে একটি রাস্তায় উঠল, যেটাতে আরও অনেক গাড়ি আটকে আছে।

এরপর সেই রাস্তা আমাদের মেইন রোডে (ঢাকা-টঙ্গী রোড) উঠতে দিল। কিন্তু উল্টো পাশে, মানে যাব ঢাকার দিকে, কিন্তু এই রাস্তা যাচ্ছে উত্তরার দিকে! রাস্তার মাঝখানে সড়ক বিভাজক, উপায় নেই অপর পাশে যাওয়ার। মেট্রোরেলের কাজ হচ্ছে অনেক দিন ধরে, তাই একটি মাত্র লেন যাচ্ছে উত্তরার দিকে। প্রচণ্ড জ্যাম চারদিকে!
ধীরে ধীরে আমরা উত্তরার জসীমউদ্‌দীন মোড় পর্যন্ত গেলাম আধা ঘণ্টায়, সেখানে গিয়ে গাড়ি ইউটার্ন নেওয়ার সুযোগ পেল ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশে! তখন বাজে সন্ধ্যা ৭টা, বুঝতেই পারেন কী প্রচণ্ড জ্যাম লেগেছিল সেই রাস্তায়। সেখানে থেকে আড়াই ঘণ্টা পর বাসায় পৌঁছতে পেরেছিলাম সেদিন। এ হচ্ছে ঢাকা ‘আন্তর্জাতিক’ বিমানবন্দরে নেমে একজন যাত্রীর বাসায় পৌঁছানোর কাহিনি! প্রথম আলো

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।