রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:০৫ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
না ফেরার দেশে চলে গেলেন বারী সিদ্দিকী : প্রধানমন্ত্রীর শোক

একুশে বার্ত রিপোর্ট : ‘শুয়া চান পাখি, আমি একটা জিন্দা লাশ, খ্যাত মরমী গানের শিল্পী বারী সিদ্দিকী আর নেই, তিনি বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে গেছেন ( ইন্নালিল্লাহে– রাজেউন)।। তার মৃত্যুতে সংগিত জগতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েিেছল ৬৩ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য ভক্ত, গুণগ্রাহি রেখে গেছেন। গত ১৭ নভেম্বর রাতে হৃদ রোগে আক্রান্ত হলে তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক আবদুল ওয়াহাবের ততা¡বধানে সাত দিন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকার পর তার শারঅরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। অবশেষে সব চিকিৎসা ব্যর্থ করে দিয়ে বারী সিদ্দিকী গত বৃহস্পতিবার রাতে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
দীর্ঘদিন সংগিতের সাথে যুক্ত থাকলেও শিল্পী হিসেবে বারী সিদ্দিকী পরিচিতি পান ১৯৯৯ সালে। এ বছর লেখক- নির্মাতা হুমায়ুন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবিটি মুক্তি পায়। এই ছবিতে তিনি ছয়টি গান গেয়ে নতুন করে আলোচনায় আসেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংগিত পরিচালক ও মুখ্য বাদ্যযন্ত্র শিল্পী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বারী সিদ্দিকীর আত্মার মাগফেরাত কামনা করে শোকার্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যত দিন লোকসঙ্গীত থাকবে, তত দিন বারী সিদ্দিকী বেঁচে থাকবেন। গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে শুক্রবার সকালে বারী সিদ্দিকীর প্রথম নামাজে জানাজা হয়। এরপর তার মরদেহ ৩২ বছরের কর্মস্থল বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দুটি জানাজায় অংশ নেওয়া শিল্পী ও কলাকুশলীদের মধ্যে ছিলেন ফকির আলমগীর, নকিব খান, শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, রবি চৌধুরী, মানাম আহমেদ, নোলক বাবু, পল্লব স্যান্নাল, জালাল আহমেদ প্রমুখ। এরপর নেত্রকোনা সরকারি কলেজ মাঠে বাদ আসর তৃতীয় নামাজে জানাজা শেষে তাকে তার নিজের ‘বাউলবাড়ি’-তে দাফন করা হয়।
বারী সিদ্দিকীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা। তিনি বলেন, বারী সিদ্দিকীর হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়া আমাদের মিউজিক ইন্ডাষ্ট্রির জন্য খুব ক্ষতি হয়েগেলো। তার ইউনিক একটি ভয়েজ ছিলো। গাওয়ার স্টাইলওটাও ছিলো ভিন্নরকম। তার গেয়ে যাওয়া গানগুলোর মধ্যেই তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। শিল্পী ফরিদা পারভীন বলেন, দেশে অনেক ডাক্তার আছেন, ইঞ্জিনিয়ার আছেন, শিল্পপতি আছেন, কিন্তু বারী সিদ্দিকী দেশে একজনই আছেন। সেই বারী সিদ্দিকী শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য অনেক কষ্টের, বেদনার। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে বারী সিদ্দিকী একজনই। আমাদের সবাইকেই যেতে হবে। আর এ জন্য মানসিকভাবে আমাদের সবাইকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়েজী বলেন, বারী ভাই আমাদের অনুভুতিকে ঋণী করে গেছেন, আমাদের হৃদয়কে ঋণী করে গেছেন। আমাদের অনুভূতি যতোদিন থাকবে, আমাদের হদয় যতোদিন থাকবে বারী ভাই ততোদিন আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। বারী ভাই আমার লেখা অসংখ্য গান গেয়েছেন। বারী ভাই আমার পরিবারেরই একজন। তার চলেও যাওয়া আমার মেনে নেওয়া অনেক কষ্টের, যন্ত্রনার। সঙ্গীতশিল্পী সামিনা চৌধুরী বলেন, বারী ভাই সত্যিকারের একজন ভালো মানুষ ছিলেন। এমন অসাধারন কন্ঠ আর আসবেনা। তার প্রতিটি গানই একেকটি অনবদ্য সৃষ্টি। কণ্ঠশিল্পী আইয়ূব বাচ্চু বলেন, বারী চলে গেছেন, সম্পদ হারানোর মিছিলে বাংলাদেশ বিশাল এক সম্পদকে হারালো। বারী ভাইয়ের মৃত্যুতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তা আর কোনকিছু দিয়েই পূরণ হবার নয়। তার বাঁশি তার কন্ঠ দুই মিলিয়েই তিনি নিজেকে বারী সিদ্দিকী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। কয়েক জনমেও আর এই দেশে একজন বারী সিদ্দিকীর জন্ম হবে না। সঙ্গীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, সত্যিই বড় অসময়ে চলে গেলেন বারী ভাই। তারবারী খুব বেশি যে বয়স হয়েছিলো তেমন নয়। আরো বিশটি বছর অনায়াসে তিনি এদেশের সংষ্কৃতির জন্য কাজ করে যেতে পারতেন। কিন্তু পারলেন না। তার পরিপূরক এই বাংলায় আর কেউ হবে না কোনদিন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো বারী ভাইয়ের সুরে তিনটি গান গাইবার। আবার আমার সুরে ‘ঢাকা ড্রিম’ চলচ্চিত্রে তিনি প্লে-ব্যাক করেছেন। এটি আগামী বছর শ্রোতারা শুনতে পাবেন। সত্যি বলতে কী বারী ভাই বাউলিয়ানা ছিলেন কিন্তু শেষ সময় ‘সেরা কণ্ঠ’তে ফোক গানের বিশেষ পর্বে যখন রাত আটটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত সময় কাটালাম তখন তারমধ্যে সংসার, সন্তান নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা দেখেছি। শিল্পী এ্যন্ড্রু কিশোর বলেন, চলমান ফোক সঙ্গীতে এক অন্যরকম ধারার সৃষ্টি করেছিলেন বারী ভাই। তার গায়কী, তার বাঁশি সবাইকে মুগ্ধ করতো। এই অসময়ে চলে যাওয়াটা আসলে মেনে নেবার মতো নয়। ভীষণ খালাপ লাগছে বারী ভাইয়ের জন্য এই ভেবে যে তিনি যদি তার শরীরের প্রতি আরেকটু যত্নবান হতেন তাহলে আমরা তাকে আরো বহুবছর পেতাম গানের ভুবনে। সঙ্গীতশিল্পী ঐশী বলেন, বারী স্যার চলে গেছেন, এটা বিশ্বাস করতেই আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি তার গান শুধু শুনতামই না মন দিয়ে অনুভব করতাম এবং এটা সত্য যে স্টেজ শো’তে বা টিভিতে কোন শো’তে আমি তার গান দিয়েই শুরু করতাম।
নেত্রকোনা জেলায় ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর বারী সিদ্দিকীর জন্ম। তার বাবা প্রয়াত মহরম আলী ও মা প্রয়াত জহুর-উন-নিসা। কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তার বাসায় যান বাঁশি বাজাতে। সেখানে বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি গানও করেন তিনি। গান শুনে মুগ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৯৫ সালে বিটিভির ‘রং-এর বারৈ’ অনুষ্ঠানে প্রথম গান করেন বারী সিদ্দিকী। এর পরপরই হুমায়ূন আহমেদ তাকে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে গান গাইতে বলেন।

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।